ধর্ষণের প্রবণতা কী ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে? ক্ষমতার দাপট বা প্রভাব–প্রতিপত্তি দেখানোর জন্যে, নাকি বিকৃত যৌন উন্মাদনার কারণে ঘটে চলেছে একের পর এক ধর্ষণ– গণধর্ষণের ঘটনা। কেন মূল্যবোধের এই চরম অবক্ষয়? কেন এই নৈতিক অধঃপতন। বিশেষ করে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে একের পর ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণ চেষ্টার অনেকগুলো অভিযোগ ওঠার পর পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে বলা চলে। গত একমাসে এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা সংবাদপত্রে এসেছে, যা সমাজের বিবেকমান মানুষকে বিচলিত না করে পারে না। ধর্ষণের ঘটনার কোনো কোনোটি আন্দোলনের ইস্যু হয়। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটে। তবে ধর্ষকের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে না সামাজিক প্রতিরোধ।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত চাঞ্চল্যকর একটি গণধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণা করেন। নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলায় চার সন্তানের জননী এক গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে দশ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ‘ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অভিযোগ‘ এনে সুবর্ণচরে স্বামী সন্তানকে বেঁধে রেখে চার সন্তানের এক জননীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় নেতৃত্ব দেন সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন মেম্বার। মামলার রায়ে রুহুল আমিনসহ ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৬ জনের যাবজ্জীবন কারদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। অভিযুক্তরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ঘটনার সময়। পরে তাদের বহিষ্কার করা হয়।
এই মামলাটির রায় যেদিন হয় সেদিনই সেই সুবর্ণচরেই ঘটে একই ধরনের আরেকটি দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষিত হন তিন সন্তানের জননী এক গৃহবধূ ও তার কিশোরী মেয়ে। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন চরজব্বরের ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল খায়ের মুন্সী। তিনি এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার। পুলিশের বরাতে জানা যায়, গৃহবধূর স্বামী বিদেশে থাকেন। মেম্বারের নজর পড়ে গৃহবধূর ওপর। সময়ে অসময়ে খোঁজ–খবর নেওয়ার নামে বাড়িতে গিয়ে গৃহবধূকে উত্ত্যক্ত করার পাশাপাশি কুপ্রস্তাব দেয়। গৃহবধূ কড়া কথা শুনিয়ে দিলে মেম্বার প্রতিশোধ নিতে চোরদের সহায়তা নেয়। সিঁদ কেটে বাড়ি ঢুকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে মা–মেয়েকে। যাওয়ার সময় নগদ টাকা ও সোনাদানা লুট করে নিয়ে যায়। এর দু‘দিন আগে ৩ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটে আরেক নারকীয় ঘটনা। আশুলিয়া থেকে এক ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে তাকে আটকে রেখে খবর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তার স্ত্রীকে। এরপর পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে নিয়ে ওই মহিলাকে করা হয় দলবদ্ধ ধর্ষণ।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন নেতার নেতৃত্বে ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন জাবি ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানসহ চার নেতা। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৬ জন শিক্ষার্থীর সনদ বাতিল করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ভিকটিম আশুলিয়ায় থাকে স্বামীর সাথে। তাদের বাসায় মামুন নামে একজন সাবলেট থাকত। যার সাথে জাবি ছাত্রলীগের নেতাদের সুসম্পর্ক ছিল। মাঝেমধ্যে সে জাবি হলেও রাত কাটাত। সেই মামুনের মাধ্যমে প্রথমে গৃহবধূর স্বামীকে ডেকে নেয়। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে খবর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর হলের নিকটবর্তী জঙ্গলে নিয়ে গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টা অভিযোগ এসেছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ভুক্তভোগী ছাত্রীকে মাস্টার্সের থিসিস নিয়ে আলোচনার কথা বলে একান্তে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালান। এর আগেও নানাভাবে যৌন নিপীড়ন করেছেন। ছাত্রী অভিযোগ করার পর জানা গেল, আরও অনেক ছাত্রী এই শিক্ষকের হাতে যৌন নিগৃহের শিকার হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী চিকিৎসক, যিনি অন্য একটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন অধ্যাপক এর বিরুদ্ধে এক নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন সহ আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে নেমেছে। রাজধানীর ঢাকার ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের আজিমপুর শাখার গণিত বিভাগের একজন শিক্ষক একাধিক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারের পর পুলিশ সেই শিক্ষকের ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনে অনেক আপত্তিকর পর্ণো ছবি ও অশ্লীল ফোনালাপের রেকর্ড পেয়েছেন। অপরাধ স্বীকার করেছেন অভিযুক্ত শিক্ষক মুরাদ হোসেন। একই সময় খুলনার পাইকগাছায় এক গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে।
১৮ জানুয়ারি লালমনিরহাট এক্সপ্রেস ট্রেনে ধর্ষণের শিকার হয় এক কিশোরী। বুঝতে না পেরে কিশোরী ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছিল। ট্রেনের অ্যাটেন্ডেন্ট আক্কাস গাজী কিশোরীকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণ করে। অভিযোগ পেয়ে অভিযুক্তকে আটক করা হয়েছে। যে কিশোরী ধর্ষিত হয়েছে তার পরিবারের পক্ষে এখন গ্রামে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে নানান কটুকথা শুনতে শুনতে মেয়েকে নিয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন কিশোরীর বাবা–মা। ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার এ রকম আরও কয়েকটি ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসেছে গত দু‘মাসের মধ্যে।
আমাদের দেশ ও সমাজে প্রতিদিন এ রকম অসংখ্য যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও তার সিংহভাগই চেপে যাওয়া হয় মান–সম্মানের ভয়ে। পরিবার কীভাবে মুখ দেখাবে, সমাজ অপবাদ, অপমান করবে বা মেয়ের বিয়ে শাদী হবে না ভেবে অনেক ঘটনা চেপে যাওয়া হয়। যারা ঘটনা প্রকাশ করে আইনের আশ্রয় নেন তারাও পদে পদে নিগৃহীত হন। আদালতে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন। বরং আদালতে কাটগড়ায় প্রতিপক্ষের অশ্লীল প্রশ্নবানে ধর্ষণের চেয়েও বেশি অপমানিত লাঞ্ছিত হতে হয় ভুক্তভোগীকে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রচলিত যে আইন তা মেনে বিচার কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হলে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টদের অনেকে। অনেকে বলেন, ধর্ষণ মামলার বিচার হতে হবে ক্যামেরা ট্রায়ালে। অনেকে ধর্ষককে ক্রসফায়ারে দেওয়া বা ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কর্তনেরও দাবি তোলেন। নীতি–নৈতিকতার সুশিক্ষা এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণ প্রবণতা রোধ করা কতটুকু রোধ করা যাবে তাও আলোচনায় আসছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল এমনকি বাসাবাড়িতেও নারী আজ নিরাপদ নয়, ধর্ষণ–শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন। যে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধর্ষক তার ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করেছিল সেই ক্যাম্পাসে আবার দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সর্বত্র আতঙ্ক ও অস্থিরতা। নারী সমাজ ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়। এসব কিসের আলামত? কেন শিক্ষকের বিরুদ্ধে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ওপর যৌনসহিংসতার অভিযোগ ওঠে?
এবার জাতীয় সংসদে ২৯ জন মহিলা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসেছেন। সংরক্ষিত আসনে ৫০ জন নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থাৎ ৭৯ জন মহিলা এখন সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। সংসদ নেতা, উপনেতা, স্পিকার মহিলা। তাই নারীর সুরক্ষা বিষয়ে সংসদে সোচ্চার আওয়াজ উঠবে এটা প্রত্যাশা করা যায়। নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধের বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।