এসএসসির ফলাফল যেন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার দিকে নিয়ে না যায়

মো. দিদারুল আলম | মঙ্গলবার , ৮ জুলাই, ২০২৫ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

চলতি মাসের যে কোনোদিন ২০২৫ সালের এসএসসি বা মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হলো ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১। ২০২৪ সালের তুলনায় এবার প্রায় এক লাখ পরীক্ষার্থী কম। গত বছর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আট ঘণ্টার মধ্যে ৯ জন আত্মহত্যা করে। এই ৯ জনের ৬ জনই ছিল মেয়ে। আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনা ছিল আরও বেশি, সেই হিসাব হয়তো প্রকাশ হয় না। এমন দুঃখজনক ঘটনা প্রতিবছরই ঘটে। পরীক্ষায় ভালো না করা মানেই যে একজন শিক্ষার্থী ব্যর্থ, তা নয়। কিন্তু সমাজ, পরিবার এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার দৃষ্টিতে পরীক্ষার ফলই হয়ে ওঠে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। প্রায় ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ পরীক্ষার্থী এখন দম বন্ধ করে ফলাফল ঘোষণার অপেক্ষায় আছে। কী হয়! কী হয়! জিপিএ, গোল্ডেন পাব তো! ফেসবুক খুললেই চোখে পড়ে এদের আহাজারি-‘আল্লাহ ইজ্জত রেখো’, মানুষের কাছে যেন মুখ দেখাতে পারি, মাবাবার ইজ্জতসম্মান রক্ষা করো, ইত্যাদি আরও কত কী! এক এসএসসির ফলাফলের সুতায় ঝুলছে মানইজ্জতসম্মানস্ট্যাটাস সবকিছু। পাবলিক পরীক্ষায় সাফল্য পেতে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষার্থীদের এই আত্মহত্যার ট্র্যাজেডির দায় কার? শিক্ষার্থীরাই কি শুধু দায়ী? সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা কি এর দায় এড়াতে পারে? পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সাফল্য পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে যত হইহুল্লোড় করা হচ্ছে, খারাপ ফলাফল করা ছাত্রছাত্রীরা কেন ফেল করল, তা নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে?

সবাই একসঙ্গে কায়মনোবাক্যে চাইলেও সবাই জিপিএ৫ পাবে না। অনেকেই অকৃতকার্য হবে, তাদের আবার বসতে হবে পরীক্ষায়। অকৃতকার্যদের পাশে রাষ্ট্রশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপরিবার কেউ দাঁড়ায় না। পরীক্ষায় যারা পাস করতে পারে না, তারা মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে বেশি হতাশ হন তাদের বাবামাভাইবোন, পরিবারপরিজন। পরিবারের গালমন্দ এবং নানা কটূক্তির কারণে এই ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ হতাশা, গ্লানি, ক্ষোভে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। পরীক্ষায় ভালো না করা মানেই যে একজন শিক্ষার্থী ব্যর্থ, তা নয়। কিন্তু সমাজ, পরিবার এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার দৃষ্টিতে পরীক্ষার ফলই হয়ে ওঠে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। ফলে অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের মন ভেঙে যায়। আমরা সব সময় সাফল্যের গল্প সামনে নিয়ে আসি, কিন্তু যেসব শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে, তারা কেন অকৃতকার্য হলো, সেই প্রশ্নটা খুব কমই করি। এর পেছনে কি মানসিক চাপ, পারিবারিক সহানুভূতির অভাব, নাকি আরও গভীর কোনো সামাজিক কাঠামোগত সমস্যা আছে, সে বিষয়ে আমাদের গবেষণা বা কার্যকর উদ্যোগ খুবই সীমিত।

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের জীবনে অভিভাবকের প্রত্যাশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সন্তান যেন ভালো রেজাল্ট করে, এটা প্রত্যেক মাবাবার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন যদি পরিণত হয় অন্ধ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়ার চাপে, তাহলে শিক্ষার্থীর মনে জন্ম নেয় ভয়, ব্যর্থতার আতঙ্ক ও আত্মঘৃণা। অনেকে ধীরেসুস্থে চিন্তাভাবনা করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তাদের ক্ষেত্রে ইঙ্গিত পাওয়া সহজ। কিন্তু হঠাৎ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আগাম আলামত আঁচ বা অনুমান করা সহজ নাও হতে পারে। তবে কাছের মানুষ, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের পক্ষে টের পাওয়া সহজ। অল্পতেই খুশি, দুঃখ ও রাগ বোধ করা কিশোর বয়সের বৈশিষ্ট্য।

পরীক্ষায় ব্যর্থতার পর পরিবারের সহযোগিতার অভাব, বরং উল্টো তাকে কটু কথা শোনানো হয়, প্রতিবেশি, আত্মীয় ও সহপাঠীদের চাপও বড় কারণ। শিক্ষার্থীরা যখন পরীক্ষা ফেল করছে বা রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে, বাবামা প্রচণ্ড বকাঝকা করছে। অনেক সময় তারা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যা বা তোর মতো সন্তান থাকার থেকে না থাকা ভালো ছিল। পিতামাতা সবচাইতে যেই ভুলটা করে সেটি হলো, অন্যদের সাথে তুলনা করা। যেমনঅমুক ভালো রেজাল্ট করেছে, তুই কেন পারলি না? শিক্ষার্থীদের এই বয়সটা এমনিতেই আবেগপ্রবণ। এই সময়ে পিতামাতার অবহেলা তাদের আরও বেশি আবেগপ্রবণ করে ফেলে। পড়াশোনা এখন পরিণত হয়েছে অস্থির সামাজিক প্রতিযোগিতায়। যেখানে মাবাবা সন্তানের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক সম্মান রক্ষার হাতিয়ার বলে মনে করেন। অভিভাবকদের এই অতি প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে উচ্চাভিলাষের কারণেই বোর্ড পরীক্ষায় পাস না করায় কিশোর কিশোরীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।

একজন শিক্ষার্থী যদি পরিবার, শিক্ষক এবং সমাজের ভালোবাসা ও সমর্থন অনুভব করে, তাহলে হতাশা যত গভীরই হোক না কেন, সে ফিরে আসবে। আমাদের উচিত, শিক্ষার্থীদের শেখানো যে তারা যেমন আছে, ঠিক তেমন করেই তারা মূল্যবান। প্রতিটি শিশু আলাদা, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সক্ষমতা ভিন্ন।

পরীক্ষায় সব সময় আশানুরূপ ফলাফল নাও হতে পারে। তার জন্য হতাশ হলে চলবে না। খারাপ ফলাফলের কারণ হতে পারে চেষ্টায় কমতি, পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব, পারিপার্শ্বিক অবস্থা কিংবা অভিভাবকের যথাযথ দায়িত্ব পালনে ঘাটতি। তাই খারাপ ফলাফল মানেই ব্যর্থতা নয়। একবার কোনো কাজে অকৃতকার্য হওয়া মানে রাজ্যের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয়ে যাওয়া। পরীক্ষার পাশফেলই সফলতা কিংবা বিফলতার মানদণ্ড নয়। অনেক ফেল করা ছাত্র কর্মজীবনে সফল হয়। আবার ঈর্ষণীয় রেজাল্টের পরও অনেকের কর্মজীবন সুখের হয় না। এর অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে আছে।

আসুন, আমরা সবাই মিলে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে ফলাফল নয়, জীবনের প্রতি ভালোবাসা থাকবে সবার আগে। অভিভাবকরা দয়া করে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকুন। কারণ, একটি জীবন, একটি ভবিষ্যৎ, তার চেয়েও মূল্যবান আর কিছু নয়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলেজ শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমদিনায় বাংলাদেশীদের কৃষি বিপ্লব
পরবর্তী নিবন্ধ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা ও তার শতবর্ষ