এশিয়ার দেশগুলোতে গত এক সপ্তাহ ধরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনটি। সংক্রমণের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়াতেও। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে এশিয়ার দেশগুলোতে বাড়তে থাকা ‘ডেল্টা ধরনের’ সংক্রমণের হার তুলে ধরে বলা হয়, পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক দেশেই বিধি-নিষেধের কড়াকড়ি আরোপসহ টিকাদান কর্মসূচির গতি বাড়ানো হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
গত বছর ডিসেম্বরে ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া ‘ডেল্টা ধরনটি’ এরই মধ্যে বিশ্বের ১০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনটি দ্রুতই করোনাভাইরাসের অন্যান্য ধরনের চেয়ে বেশি ‘দাপুটে’ হয়ে উঠবে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গতকাল শুক্রবার অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসে দৈনিক সংক্রমণের হার এ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওই রাজ্যে শনাক্ত রোগীর বেড়ে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০ জনে, যাদের বেশিরভাগই ডেল্টা ধরনে সংক্রমিত।
সংক্রমণ ঠেকাতে দুই সপ্তাহের লকডাউন চলছে সিডনিতে। দেশটির ২৫ কোটি মানুষের এক পঞ্চমাংশের বসবাস এই নগরে। দেশব্যাপী টিকা দেওয়ায় ধীরগতি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ারও করেছে সিডনি।
ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটির কলেজ অব মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক জিল কার বলেন, আমি মনে করি টিকা পেলে এই রোগ অবশ্যই কমবে, এটা হাসপাতালে ভর্তির হারও কমাবে। কিন্তু তা না হলে যাদের টিকা দেওয়া হয়নি, আমরা আসলে তাদের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত করে দেব। এশিয়ার অনেক দেশের মত অস্ট্রেলিয়ার মানুষের মধ্যেও মহামারী দমনে টিকা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। এছাড়া টিকা সরবরাহেও ছিল ধীরগতি।
অস্ট্রেলিয়ায় মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশকে এপর্যন্ত টিকা দেওয়া গেছে। এশিয়ার দেশ জাপানে করোনাভাইরাসের টিকা পেয়েছেন ১২ শতাংশ মানুষ। বুধবার জাপান জানিয়েছে, টোকিওসহ পূর্বাঞ্চলে সংক্রমণের এক তৃতীয়াংশের জন্যই করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন দায়ী। জুলাইয়ের মাঝামাঝি তা বেড়ে ৫০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলেও জানিয়েছে দেশটি।
টোকিও এবং এর আশপাশের তিনটি এলাকায় আধা জরুরি অবস্থা জারি রয়েছে। সম্প্রতি সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশটির কর্মকর্তারা বিধি-নিষেধ বহাল রাখার সুপারিশ করেছেন।
ভাইরাসের ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় জাপানে এ মাসে অলিম্পিক গেইমস নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শুক্রবার টোকিওর গভর্নর ইউরিকো কোইকে আবারও বলেছেন, পরিস্থিতির অবনতি হলে আগামী ২৩ জুলাই শুরু হতে যাওয়া অলিম্পক গেইমসে দর্শনার্থীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা শুক্রবার জানিয়েছেন, শুক্রবার ৮০০ জন নতুন রোগী পাওয়া গেছে সেখানে, যা ৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশটির মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশকে এ পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছে।
সংক্রমণের গড় হার গত ১০ দিন ধরে বাড়তে থাকায় রাজধানী সিউলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধি এখনই শিথিল করা হচ্ছে না। সিউলের ‘এউহা উইমেন্স ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার’ এর শ্বাসতন্ত্রের রোগ বিশেষজ্ঞ চুন ইউন-মি বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হচ্ছে এমন এক ধরন, যা ব্যাপক মাত্রায় সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। ইন্দোনেশিয়া, ভারত এবং ব্রিটেনের সংক্রমণ বলছে শুধু কোরিয়া নয় আরও অনেক দেশকেই তাদের টিকা দেওয়ার কৌশল নিয়ে আবারও ভাবতে হবে এবং নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে।
সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ায় গত শনিবার থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ভারতে অবশ্য সংক্রমণের হার দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে কমে এসেছে। গত মে মাসে দৈনিক সংক্রমণ ৪ লাখ পর্যন্ত উঠেছিল, যে কারণে গণ টিকাদানে গুরুত্ব দিচ্ছে দেশটির সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের যেসব অঞ্চলে টিকা দেওয়ার হার কম, সেখানেও ডেল্টা ধরনের কারণে সংক্রমণ বেড়েছে। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, সংক্রমণের ওইসব কেন্দ্রে বিশেষ সহায়তা পাঠানো হবে।
ইউরোপে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির জন্য ২০২০ ইউরো ফুটবলের স্টেডিয়ামে দর্শকের ভিড়কে দায়ী করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। নিয়ম-কানুন না মানলে সংক্রমণের নতুন ঢেউ অনিবার্য বলেও সতর্ক করেছে এ বিশ্ব সংস্থা। ডেল্টা ধরনের কারণে সংক্রমণ বাড়লেও আগামী ১৯ জুলাই লকডাউনের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্রিটেন। বৃহস্পতিবার জার্মানি জানিয়েছে, এ মাসে সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ডেল্টা ধরনের কারণে হতে পারে। সংক্রমণ বাড়ায় পর্তুগালে এরই মধ্যে রাত্রিকালীন কার্ফু জারি করা হয়েছে।
নতুন করে সংক্রমণ বাড়ায় ইউরোপে গ্রীষ্মকালীন পর্যটন হুমকিতে পড়লেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কোভিড-১৯ এর ভ্রমণ সনদ দেওয়ায় পর্যটকদের ভ্রমণ বাড়তেও পারে। বৃহস্পতিবার ইউরোপের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে করোনাভাইরাসের যেসব টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা ডেল্টা ধরনসহ সব করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেবে।
এশিয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যটন ব্যাপক হারে স্থগিত করা হলেও টিকার পূর্ণ ডোজ যারা পেয়েছেন, তাদের জন্য বৃহস্পতিবার থেকে থাইল্যান্ডের ফুকেট আইল্যান্ড আবারও খুলে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবারও থাইল্যান্ডে টানা তৃতীয় দিনের মত করোনাভাইরাসে রেকর্ড মৃত্যু হয়েছে। এ দেশটিতে এখনও যুক্তরাজ্যে প্রথম পাওয়া করোনাভাইরাসের আলফা ধরনের আধিপত্য থাকলেও কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছে, সামনের কয়েক মাস ডেল্টা ধরনের দাপট থাকবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কুমনুয়ান উংচুসাক বলেন, ব্যাংককে এর সংক্রমণ প্রায় ৪০ শতাংশ, এই মাস কিংবা পরের মাসে সবই অবশ্য ডেল্টা হয়ে যাবে। মৃত্যুহারের ঊর্ধ্বগতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমনটা যদি চলতে থাকে আমরা আর বাঁচতে পারব না।