১৯৬৪ সালে আমি স্থায়ীভাবে চাটগাঁ শহরে চলে আসি। তখন আমি সাতকানিয়া কলেজের ছাত্র। লেখাপড়ার ছেদ পরে বাবার মৃত্যুতে। কিন্তু সাহিত্যচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ শহরে এসে। সম্ভবত মেজভাই জহুর–উশ–শহীদের সাথে একদিন আমি এল.এ. চৌধুরী সাহেবের বড় জামাতা চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল শিল্পী সবিহ–উল–আলমের চট্টগ্রামের প্যারেডের কোণায় ‘তালতলা’র বাসায় যাই। সেখানে সেলিমা ভাবী ও জনাব মেজবাহউদ্দিন জঙ্গীর সাথে আমার পরিচয়। মেজবাহের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাদের বাড়িতে যখনই সময় পেতাম চলে যেতাম। মেজবাহ‘র বাবা জনাব এল.এ. চৌধুরী আমাকে ডেকে বসাতেন। প্রথমে আপ্যায়ন তারপর নানা প্রসঙ্গে আলোচনা করতেন, তখন আলোচনায় বয়সের ব্যবধান ঘুচে যেতো। প্রথম প্রথম আমি তাঁকে একটু ভয় পেতাম। মেজবাহ না থাকলে আমি চলে আসতাম। এভাবে কয়েকদিন ফিরে আসার পর তিনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন “প্রতিদিন ফিরে যাও কেন? তাঁর কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে এলো। আমি আমতা–আমতা করছি–কী জবাব দেব। বসার পর তিনি কথা বলতেন। চট্টগ্রাম শহরে আসার পর আরেকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সন্দ্বীপের জনাব রফিক উল্লাহ চৌধুরী (সাবেক এমপি) সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। তিনি কোন একটা কারণে আমাকে খোঁজ করেছিলেন কখন চট্টগ্রামের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এ.কে. খান সাহেবের ভাতিজা মুক্তিযোদ্ধা মরহুম হারুন খান বললেন মসউদকে খুব সম্ভব এল.এ.চৌধুরী বাসায় পাওয়া যাবে। রফিক সাহেব সাথে সাথে ছুটলেন সেখানে হারুন খান সাহেবের ধারণা ঠিকই হল। তিনি আমাকে পেলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তি এল.এ. চৌধুরী সাহেবের বাসায় তাঁর সামনে বসা। রফিক সাহেব বিনীতভাবে বললেন, একটা অনুষ্ঠানে আমার ছেলে গান গাইবে, সে মসউদকে ছাড়া যাবে না, তাই মসউদকেও একটু নিয়ে যাবো। এল. এ. চৌধুরী সাহেব হেসে বললেন, “নিয়ে যান এদের নিয়েই তো জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি হবে। গাড়িতে বসে রফিক সাহেব বললেন, ‘এই এল.এ চৌধুরী সাহেবকে দেখলে। জানো? তিনি কত বড় মাপের লোক। তিনি একাধারে সমাজ সেবক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতা ও হৃদয়বান ব্যক্তিত্ব।আসলে তিনি একজন অনন্যসাধারণ আদর্শ মানুষ। হ্যাঁ সেই অসাধারণত্ব খুঁজে পেলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছি আমার বন্ধু বান্ধবরা তো আছেই চট্টগ্রামে নবাব সিরাজ–উদ–দৌলা রোডের দেওয়ান বাজার সাব এরিয়ার ডা. আজিজ উল্লাহ সাহেব,আমার মেজ ভাই জহুর–উশ–শহীদও আমাকে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন রিপোর্ট তৈরীর কাজে লাগালেন। চন্দনপুরার অরোরা প্রিন্টাসের্র মালিক বেবী সাহেবের প্রেসে বিভিন্ন রকম লিফলেট ছাপা হতো। এসব আমাকে দেখতে হতো। ঐ প্রেসে যাবার পথেই ছিল মেজবাহউদ্দিন জঙ্গীর বাবা জনাব এল.এ চৌধুরীর বাড়ি। এদিকে মেজবাহ এবং তার ছোট ভাই বুরহান উদ্দিন জঙ্গীও মুক্তিযুদ্ধে কাজ করেছেন তিনি একটি রেডিও মেরামতের দোকান ‘সবকিছু’ এনামে খুলে বসলেন ৮৫ নম্বর দেওয়ান বাজারে নবাব সিরাজ–উদ–দৌলা সড়কে। সেখানে সীমান্তের ওপার (আগরতলা) থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নানারকম বুলেটিন ও পত্রিকা আসতো। আমরা এসব পত্রিকা পড়তাম আর বিভিন্ন রকম পরিকল্পনা করতাম। এদিকে জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা চন্দনপুরা মসজিদের পেছনে একটি তথ্য কেন্দ্র খুলেছেন– মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর নিতে। তবে সেটা মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে কাজ করার জন্যে একটা ফাঁদ ছিলো। আমাদের গোপনীয় কাজকর্মে জনাব এল এ চৌধুরী উৎসাহ দিতেন, তিনি আমাকে বলতেন-“যা করো খুব সাবধানে করো ।” জনাব এল. এ. চৌধুরী সতর্ক না করলে হয়তো সেই ফাঁদে অনেকেই আটকে যেত। এল. এ. চৌধুরী ছিলেন একজন নীরব আলোর দিশারী। তাঁর কাজ ছিল–নীরবে নিভৃতে তরুণ সমাজকে জাতিকে আলোর পথে টেনে নেয়া। স্বাধীনতার পরপরই তারই অনুপ্রেরণায় ও দেওয়ান বাজার লেনের চট্টগ্রাম এর বাসায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রথম সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সাহিত্য সভায় এত লোক সমাগম হয় যে, সেটা আর ঘরোয়া সাহিত্য সভা থাকেনি। সেই এক স্মরণীয় ঘটনা। চট্টগ্রাম এমন একটি জায়গা যেখানে শুধু ক্ষণজন্মা মহৎ মানুষেরা জন্মগ্রহণ করেন,সেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের নতুন নতুন উন্মেষ ঘটে। আজকে পুরো দেশটা ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়াতে এসব ক্ষণজন্মা পুরুষ ও তাদের উদ্ভাবিত কাজ কর্মের। ধারণা কেন্দ্রীভূত যেন শুধু ঢাকাতে পেছনে পড়ে থাকে সেই মহৎপ্রাণ মানুষ ও তাদের পরিকল্পনা। ফলে সঠিক মূল্যায়ন হয় না। জনাব এল.এ.চৌধুরীর বেলায়ও আজ তা ঘটেছে কিন্তু আমাদের তো কিছু দায়িত্ব আছে। বিশেষ করে চাটগাঁয়ে যারা জন্মেছেন বা বড় হয়েছেন তারা তো এ ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে রাখলে চলবে না। আমাদের উচিৎ এসব বিশ্বতপ্রায় ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের কর্মকাণ্ডকে জাতির সামনে তুলে ধরা। এল.এ.চৌধুরী ১৯১৪ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম লুৎফে আহমেদ চৌধুরী। তাঁর পিতার নাম আব্দুল লতিফ। জনাব এল এ চৌধুরী শৈশবে মাকে হারান। তাঁর ছোট খালা মাতৃহারা সকল সন্তানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনিও খুব ব্যক্তিত্বশীলা মহিলা ছিলেন। বাইরের কেউই বুঝতে পারতো না যে, তিনি সৎ মা এরকম ব্যক্তিত্বের কারণেই হয়তো এল.এ.চৌধুরীও একজন মহৎ লোকে পরিণত হতে পেরেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাখা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমি শুধু একজন আদর্শ পিতার পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করব। তিনি তার সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বড় ছেলে জনাব মরহুম সালাউদ্দিন জঙ্গী চৌধুরী সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ষাটের দশকে তিনি একজন তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান মরহুমা সেলিমা সবিহ শিশুসাহিত্য জগতে সকলের সাথে সুপারিচিত ও সকলের একজন প্রিয় ব্যাক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি এদেশের সবচেয়ে নিয়মিত ও পাঠকনন্দিত শিশু–কিশোর পত্রিকা ‘টইটম্বুর’ এর সার্থক সম্পাদক। তৃতীয় সন্তান মেসবাহউদ্দিন জঙ্গী। তিনি বর্তমানের ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। তিনিও পিতার মতো সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত। তিনি ঢাকা নিউ ইস্কাটনস্থ ইস্পাহানি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের সভাপতির দায়িত্ব (২০০৩–২০০৫ ইং) পালন করেন। চিটাগাং জার্নালিস্ট ফোরাম ঢাকা (সি.জে.এফ.ডি‘র ২০০৪– ২০০৫ইং) এর সভাপতি ও রোটারি ক্লাব অব ঢাকা ওয়েস্টের সভাপতি (১৯৯৮– ১৯৯৯ইং) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯২ সালে ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের নিয়মিত শিশু কিশোর মাসিক পত্রিকা টইটুম্বুর এর প্রকাশক, পরামর্শক ও পরিচালনা সম্পাদক। তিনি সমাজকর্মের জন্য সংবর্ধিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন। মেসবাহ একজন কবি। আমি নিজেই তার কবিতার ভক্ত। বুরহান উদ্দিন জঙ্গীর কথা তো আগেই লিখেছি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার কাছে সর্বাধিক সমাদৃত। তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার শিশু–কিশোরদের পাতা, “নতুন কুঁড়ি আসরের” প্রতিষ্ঠাতা পরিচালনা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন সরকার দেশের পত্রিকার সংখ্যা সীমিত করলে তাঁকে ঢাকায় বাংলাদেশ সচিবালয়ে আত্মীকরণ করা হয়। কিন্তু এর পরও তিনি টইটম্বুরে নিজেকে জড়িত রাখেন। দ্বিতীয় মেয়ে কাউসার পারভীন চৌধুরী ও জামাতা ডঃ ফকরুজ্জমান ফুয়াদ ম্যানিলার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে কাজ করেন। তিনি ডক্টর ইন এডুকেশন। তৃতীয় মেয়ে রাশেদা কবির ডলি। তার স্বামী জনাব কবির আহম্মদ একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। চতুর্থ ছেলে গীতিকার শহিদ মাহমুদ জঙ্গী, তিনি চট্টগ্রামে এমইএস কলেজে অধ্যাপনা করেন। ছোট মেয়ে সুব্রানা শামীম মুকুল আর্টিস্ট। পঞ্চম ছেলে মরহুম ওয়াহিদ মাহমুদ জঙ্গী, তিনি একজন সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী ছিলেন। ষষ্ঠ ছেলে আশিক মাহমুদ জঙ্গী, দেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স ঢাকা–এর জিএম ছিলেন। তিনি মরমী গানের শিল্পী। কনিষ্ঠ সন্তান মঈন উদ্দিন মাহমুদ জঙ্গী, তিনি কম্পিউটার সায়েন্সে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বর্তমানে আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় কম্পিউটার সম্পৃক্ত কাজে কর্মরত আছেন। এল.এ. চৌধুরী সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ে তারুণ্যের বখে যাওয়ার সময় একটি বিশাল পরিবারের কান্ডারী হয়ে তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ডের মত নিজের পরিবারটিও সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তুলেছিলেন।
তাঁর সকল কাজের পাশপাশি আদর্শ পিতার ভূমিকাটিও বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঐ পরিবারে মিশে আমিওতো কিছু না কিছু ভালো কাজে প্রভাবিত। তিনি চট্টগ্রাম থেকে “আল হেলাল” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন। এ. কে. ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসাবে কাজ করে গেছেন দেশ গড়ার রাজনীতি। শুধু তাই নয়, ১৯৫৪ সালে শেরে বাংলা কৃষক শ্রমিক পার্টির চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ও ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্টের চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক হিসাবেও তিনি নেতৃত্ব দেন । পথ গড়ে যাওয়ার এই সদিচ্ছাকে জনগণের মনে প্রথিত করার জন্য তিনি দৈনিক আজাদী ও বিভিন্ন পত্রিকায় সমাজ সচেতনমূলক ও প্রতিবাদী প্রবন্ধ লিখেছেন এবং বিবৃতি দিয়েছেন। পরবর্তীতে দেশের সব বড়বড় গণতান্ত্রিক দল এক হয়ে পাকিস্তানের সামরিক প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলনে ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ গঠিত হলে তিনি চট্টগ্রাম জেলার ভাইস চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে ‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও জনগণ’ নামে একটি গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। যেটা পক্ষান্তরে স্বধিকার ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনেকটুকু বেগবান করে। উল্লেখ যে, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর দেওয়ান বাজার লেনস্থ বাসভবন হতে স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা অসুস্থ শরীরে বৃদ্ধ বয়সে তিনি গ্রেফতার হন। বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী হিসাবে তিনি রাউজান গহিরা হাই স্কুল, চন্দনপুরা গুল–এ–জার বেগম মুসলিম গার্লস হাই স্কুল, মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি, এম.ই.এস কলেজ ও হাইস্কুল, চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ ও চট্টগ্রাম শহর সমাজ কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম যক্ষ্মা সমিতির আজীবন সদস্য এবং চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক বোর্ডের সদস্যসহ বিভিন্ন শিক্ষা সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম যক্ষ্মা সমিতির আজীবন সদস্য এবং ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সদস্যসহ বিভিন্ন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকে সমাজ ধর্ম, মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখেন। এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তি ১৯৭৬ সালে ১৩ জুন ইন্তেকাল করেন। প্রতিবছর জুন মাস এলে তাঁর গুণগ্রাহীরা তাঁকে স্মরণ করেন। তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকুন এটাই সকলের কাম্য।
লেখক : কবি ও শিশুসাহিত্যিক।