করোনা নামক মহামারির শুরুতে নারীর প্রতি শারীরিক ভাবে সহিংস আচরণ যেন হঠাৎ করেই স্তিমিত। যদিও একে পুঁজি করে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আমাদের হতাশ করেছে।।
কিন্তু এখন আবারও দেখি ক্ষোভে ও বেদনায় কিভাবে প্রতিদিন নানাভাবে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ। এযেন এক দৃশ্যমান সহিংস প্রতিযোগিতা। প্রতিবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। গ্রেফতারও হচ্ছে কিন্তু এরপরে শুধু এক বিশাল শূন্যতা! নারীর কী অপরাধ! তাঁর শরীর! যে কারণে শুধুই ভোগ্যপণ্য। অতীতে নারীর ক্রয় বিক্রয়, বর্ণপ্রথা, পতিতা বৃত্তি, পাচার, হারেমে তাঁদের ব্যবহার, ফতোয়াবাজ সহ কতোভাবেই যে নারীর প্রতি অবিচার। ১৯৭১ সালে নারীরা কিভাবে আক্রান্ত হয়েছে পাক সেনাবাহিনীর হাতে তাতো জানি। কিন্তু এ স্বাধীন দেশে! প্রথম মহান একুশের রাতে নারীর শরীরের ওপর আক্রমণ হয়েছে —হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন।
আর এখন এটি যেন এক ধারাবাহিক চিত্র। কী লজ্জা। কী অপমান। কী যন্ত্রণা। আর এই মহামারিতে যেখানে প্রায় প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল! কিন্তু থেমে নেই নারীর শরীরের ওপর আক্রমণ।
নারীর শরীর ঘরে ও বাইরে কোথাও নিরাপদ না। ” ন হন্যতে” উপন্যাসে মৈত্রীয়দেবী লিখেছেন কিভাবে বার বছরের মেয়ে শিশুওযেমন কাছের পুরুষ আত্মীয়ের কাছে শারীরিকভাবে নিপীড়নের শিকার তেমনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্ধেক জীবন উপন্যাসেও তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই নিষ্ঠুর সত্যিকে।
ধর্ষণ হচ্ছে ক্ষমতা প্রদর্শনের– দমন – পীড়নের— কর্তৃত্বের বিকৃত মানসিকতার বিলাস— এ ক্ষমতা পুরুষের —শ্রেণীয় — জাতি বর্ণের —প্রশাসনিক রাজনৈতিক ক্ষমতার। প্রতিপক্ষ এক অসহায় নারী। যিনি কিনা সৃষ্টির প্রতিনিধি তথা মা। তাঁর হাহাকার, যন্ত্রণা, কষ্ট যে অন্যের আনন্দ উল্লাস হতে পারে! এর চাইতে বেদনা ও ক্ষোভের আর কি হতে পারে! তাদের কাছে নারী শুধুই ভোগ্যপণ্য!
ঘরে যারা মুখোশ পড়ে বালিকা, কিশোরী বা গৃহকর্মীর প্রতি এ আচরণ করে তারা মানসিক বিকৃতির শিকার। কিন্তু বাইরে যারা—তারা কেউ গণ পরিবহনের চালক বাহেল্পার, ছাত্রাবাসের তথা কথিত দলীয় কর্মী বা পাড়ার বখাটে তরুণ বা বয়সীকেউ। আমি নিশ্চিত তারা যেভাবেই হোক মাদকাসক্ত। পেছনে আছে এক মাফিয়া চক্র। যারা শক্তিশালী। এর সাথে যুক্ত পর্নোগ্রাফি। একটি তথ্য সূত্রে জানাগেছে যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে বিনিয়োগবেশ বড়ো অংকের। আন্দ্রেদোওরকিন তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন পর্নোগ্রাফি কি আগ্রাসী রূপ নিয়েছে।
মোবাইলে এখন এটি একদম খোলামেলা যা সবার হাতে। সুতরাং আসক্তির সাথে এটি যখন যুক্ত হয় তখন কি আর মানুষ থাকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ও ঠিক ইতিবাচক ভূমিকা পালন চলছে। বিজ্ঞাপন বা নাটকেও আমরা কি তেমন গভীর বার্তা রাখতে পারছে। ধর্ষণ বেড়েছে! কিন্তু এর বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন আছে কি! প্রতিবাদ হচ্ছে সামাজিকযোগাযোগ বা মিডিয়ায়। কিন্তু নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সামাজিক সংগঠন বিশেষত নারী সংগঠন বা তথাকথিত সুশীল সমাজের ভূমিকা কতোটা! তবে আন্দোলনের ক্ষেত্রে অতীতের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কিশোরদের কি করুণ অবস্থা হয়েছিল তাও ভুলিনি।
নারীর নিরাপত্তা প্রশ্ন পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের। হয়তোবা গলদ ওখানেও আছে। পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব, আর্থসামাজিকক্ষেত্রে দুর্নীতি, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন সাথে যুক্ত হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
এ পর্যন্ত এমন কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ কি আছে!
আমরা নারীর ওপর এ নিপীড়নের, এই অমানবিক আচরণ বন্ধের ক্ষেত্রে আবারও রাষ্ট্রের সঠিক নির্দেশনার দিকে চেয়ে আছি। এ কষ্ট আর এ বেদনা যে আর নেওয়া যায় না। নারী প্রশ্ন গভীর ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ও প্রশ্ন বিচ্ছিন্ন কিছু না। সমাজের, ঘরে বাইরের, মতাদর্শিক, আইনগত, রাজনৈতিক রূপান্তরের বিষয়টি কোনভাবেই উপেক্ষিত বিষয় না।
লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ