পর্ব–১
৮ মে ১৯৬২ সাল।
হিমালয়ে এক বরফখণ্ডে দাঁড়িয়ে চার পর্বতারোহী। ওদের মালবাহকেরা উজ্জ্বল আলোয় সুক্ষ্ম বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের যাত্রাপথ সম্পূর্ণই অনিশ্চিত। কারণ পরের এক মাস উইড্রো উইলসন স্যয়ার, নরম্যান হ্যানসেন, রজার হার্ট এবং হান্স–পিটার ডুটল নিজেরাই হবেন নিজেদের একমাত্র অবলম্বন।
পরদিন ভোরে তাঁরা লক্ষ্যের পথে যাত্রারম্ভ করবেন। কাঠমান্ডুতে অনুমতি নেওয়ার সময় স্যয়ার বলেছিলেন তাঁদের লক্ষ্য গেয়াশুং কাং পর্বতে প্রথম আরোহণ। নেপাল–তিব্বত সীমান্তে এভারেস্ট ও চৌ–ইয়্যুর মধ্যবর্তী সর্বোচ্চ পর্বত হলো ২৬,০৮৯ ফুট উচ্চতার এই সুন্দর স্বতন্ত্র শৃঙ্গ। এরা সফল হলে তা হবে দুর্দান্ত ব্যাপার। কারণ এই চারজনের কেউই ইতোপূর্বে হিমালয়ে অভিযান করেনি। এমনকি শুধু দুইজনের আছে ২০,০০০ ফুট উচ্চতা অতিক্রমের অভিজ্ঞতা।
কিন্তু গেয়াশুং কাং শীর্ষে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কোনো মানুষের পা পড়েনি! পড়বে কীভাবে! ১৯৬২ সালের অভিযাত্রীদের মনে তো ছিল অন্য কথা। ওদের লক্ষ্য ছিল পূর্বে অবস্থিত ভিন্ন পর্বত–এভারেস্ট! অন্যরা দৃষ্টির আড়াল হতেই তাঁরা সেদিকে পা চালালেন। নেপালের দিক থেকে এভারেস্ট আরোহণের অনুমতি তাঁদের নেই। উল্টো ১৯৫৩ সালে হিলারি–তেনজিং–এর পথ নয়, ওদের লক্ষ্য ছিল তিব্বতে ম্যালরি–আরভিনের নর্থ ফেইস। প্রতিবেশী দুই দেশে তখন চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। ওই প্রতিকূল সময়ে নেপাল দিয়ে প্রবেশ করে তিব্বত দিয়ে এভারেস্ট চড়ার পরিকল্পনা কল্পনাকেও হার মানায়। দেশে ফিরে এই চারজন নিজেদের গল্প শোনালে বিশ্ব শান্তিকে হুমকিতে ফেলার দায়ে সুশীল সমাজের তীব্র সমালোচনার মুখে পরেন। স্যয়ারদের ওই অভিযানকে আখ্যায়িত করা হয় পর্বতারোহণের নৈতিকতা বিবর্জিত, অনভিজ্ঞদের এক হঠকারী কাজ হিসেবে।
প্রথাবিরোধী এই ছোট্ট দলের নেতা স্যয়ার ছিলেন আমেরিকার এক সুখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর দাদা ছিলেন আমেরিকার ২৮তম প্রেসিডেন্ট উইড্রো উইলসন এবং বাবা জাতিসংঘে আমেরিকার দূত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি বিমানবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। হার্ভার্ড এর পিএইচডি ডিগ্রিধারী স্যয়ার ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষকতা করেছেন। তবুও তিনি ছিলেন শিক্ষাজগতের সাথে বেমানান। একবার ৪র্থ তলার শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন বাইরের দেয়াল চড়ে জানালা দিয়ে। এসব কর্মকান্ড ছিল তাঁর রাশভারী সহকর্মীদের অপছন্দ। তাঁরা ১৯৬৪ সালে স্যয়ারের চাকরির মেয়াদ বর্ধিতকরণের বিরুদ্ধে রায় দেন। কিন্তু তিনি ছিলেন কল্পনাবিলাসী ও আদর্শবাদী। তিনি বলেন, ‘সমাজ মানুষের সম্পর্ক ঠুনকো করতে চায়, আর পর্বতারোহণ করে গভীর। সমাজ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর নিয়মকানুন আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়, আর পর্বতারোহণ করে তা শিথিল।’
১৯৫০ সালের শুরুতে হ্যানসেনের সাথে মিলে স্যয়ার এভারেস্ট স্বপ্নের বীজ বপন করেন। ওই সময় শীর্ষ পর্বতারোহীরা প্রত্যেকেই কোন না কোন ক্লাবে যুক্ত ছিলেন। ক্লাবকে পর্বতারোহণের শিল্প, মূল্যবোধ এবং নৈপুণ্যের ধারক ও বাহক বলে মনে করা হতো। সদস্য হতে ফরম পূরণ করে চাঁদা দেওয়া যথেষ্ঠ ছিল না। ক্লাবের সদস্যরা কাউকে মনোনীত করলে পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা বিবরণী জমা দিতে হতো। এরপর কমিটির অনুমোদন পেলেই জুটতো সদস্যপদ।
১৯৫৪ সালে স্যয়ার এবং হ্যানসেন ৬,২৮৮ ফুট উচ্চতার মাউন্ট ওয়াশিংটনে এএমসি’র শীতকালীন অভিযানে অংশগ্রহণের আবেদন করেন। দড়ি, ক্র্যাম্পন এবং আইস–এক্স ব্যবহারের প্রাথমিক ধারণা পাওয়া ছিল এর উদ্দেশ্য। অভিযানে যোগদানের পূর্বশর্ত ছিল কমপক্ষে একটি শৈলারোহণ কর্মশালা করা থাকতে হবে। সেটা তাঁদের ছিল না। তাই বাতিল হলো আবেদন। ব্যর্থ হয়ে তাঁরা গেলেন আলাস্কা। সেখানে ওয়েস্ট বাট্রেস দিয়ে সামিট করে ফেললেন উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট ডেনালি, যা মাউন্ট ওয়াশিংটন থেকে ১৪,০০০ ফুট উঁচু। এই রুটে প্রথম আরোহণ হয় এর মাত্র তিন বছর আগে। তাই এই কীর্তি ওই দুই অনভিজ্ঞ অভিযাত্রীর জন্য ছিল বিশাল অর্জন। তবে অভিযানে আত্মবিশ্বাস বাড়লেও অভিজ্ঞতা খুব একটা বাড়েনি। স্যয়ার বলেন, ‘আমরা পিছলে যাইনি। তাই পতন থামাতে দড়ির ব্যবহারও শেখা হয়নি।’
একাকী থাকতে ভালোবাসা স্যয়ারের আল্পাইন ক্লাবের সদস্য হবার আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এই ধরণের সংযুক্তি বা বড় কীর্তি ছাড়া নরম্যান ডাইরেনফোর্টের আয়োজনে ১৯৬৩ সালে আমেরিকার এভারেস্ট অভিযানে সুযোগ মেলার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তাই লুকিয়ে অভিযানেই ছিল একমাত্র পথ। কারণ নেপাল বা মাওবাদী চীন–কেউই ওদের এভারেস্ট আরোহণের অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য স্যয়ার এই ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করেননি। কারণ সারা জীবনই তাঁর ছিল চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুনে বিতৃষ্ণা এবং সুযোগ পেলেই তা ভাঙার প্রবৃত্তি।
ডেনালি অভিযানের ৭ বছর পর স্যয়ারের বয়স ৪২ এবং হ্যানসেনের ৩৫। ১৯৬১ এর শরতের এক বিকেলে স্যয়ার বন্ধুকে বললেন, ‘বুঝেছো নর্ম, আমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। তাই হয় এবছর, নতুবা কখোনোই নয়।’ তাঁরা এভারেস্টের পরিকল্পনায় তিনটি মূল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। যাচ্ছেন অনুমতি ছাড়া, শেরপা ছাড়া এবং কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া। প্রয়োজনীয় অর্থের প্রায় পুরোটাই স্যয়ার জোগাড় করে পরের ফেব্রুয়ারিতে বেরিয়ে পরলেন কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে। সাথে গেলেন স্যয়ারের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের এথলেট, ২১ বছরের হার্ট। পথিমধ্যে আল্পসে যাত্রাবিরতিতে নিয়োগ দিলেন অভিযানের চতুর্থ সদস্য ২৪ বছর বয়সী সুইস স্কুল শিক্ষক ডুটলকে। দুই তরুনের কারোই পর্বত অভিযানের অভিজ্ঞতা নেই। হার্ট এবং ডুটল ভেবেছিলেন তিব্বতে পাড়ি দেওয়ার সময় তাঁরা দুজন মূলত মালামাল বহন করবেন এবং আরোহণ করবেন অভিজ্ঞ দুইজন।
প্রস্তুতিপর্বে ওরা পূর্ববর্তী অভিযানগুলোর বিবরণী মুখস্ত করে ফেলেন। সব অভিযাত্রীর কীর্তির কথা ওদের জানা। জানা ছিল সাফল্য এবং ব্যর্থতা। অনুমান ছিল নিজেদের করণীয় সম্পর্কে। ১৯৫২ সালে ব্যর্থ চৌ–ইয়্যু অভিযানে এডমুন্ড হিলারি এবং জর্জ লৌয়ে ১৯২০ সালের ব্রিটিশ এভারেস্ট অভিযানের ক্যাম্পসাইটে যেতে পাড়ি দেন ১৯,৪০০ ফুট উচ্চতার নুপ–লা। চীনের কমিউনিস্ট প্রহরীদের হাতে পরার শঙ্কা এবং পথে ভয়াল সব বাধার কারণে কেউই এরপর নুপ–লা’র দিকে পা বাড়ায়নি। স্যয়ারের লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয়বারের মতো নুপ–লা পাড়ি দিয়ে কিংবদন্তি ম্যালরি–আরভিনের রুট দিয়ে শীর্ষ আরোহণের!