এভারেস্টর চূড়াত চাটগাঁইয়া পোয়া। এভারেস্টের চূড়ায় চট্টগ্রামের ছেলে। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে প্রথম চাটগাঁইয়া হিসেবে বাংলাদেশের লাল–সবুজ পতাকা ওড়ালেন ডা. বাবর আলী। তার বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চরে। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ৮টায় ৬ষ্ঠ বাংলাদেশি এবং প্রথম চাটগাঁইয়া হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন তিনি। ১১ বছর পর কোনো বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করার কৃতিত্ব দেখালেন। শুধু এভারেস্ট নয়, পৃথিবীর চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ হিমালয়ের লোৎসেও জয় করার লক্ষ্য রয়েছে বাবর আলীর। গত মধ্যরাতে লোৎসের পথে তার যাত্রা করার কথা। এটি জয় করলে তিনিই হবেন প্রথম বাংলাদেশি, যিনি একই সামিটে দুটি পর্বতশৃঙ্গ জয় করবেন। ডা. বাবর আলীর এভারেস্ট অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান গতকাল আজাদীকে জানান, এভারেস্ট জয়ের পর বাবর বেস ক্যাম্প–৪ এ নেমে এসে বিশ্রাম নেবেন। রাতে তিনি লোৎসে শৃঙ্গের পথে যাত্রা করবেন। আজ ভোরে তার লোৎসে শৃঙ্গে পৌঁছানোর ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ফরহান।
বাবরের অভিযানের সমন্বয়কারী ভার্টিকাল ড্রিমারস তাদের ফেসবুকে লিখেছে : এর আগে পাঁচ বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করলেও চট্টগ্রাম থেকে বাবরই প্রথম। তাই চট্টগ্রামবাসী তার এই বিজয়ে উদ্বেলিত।
ফেসবুকে নানাজনের টাইমলাইন এখন বাবর আলীর প্রশংসায় ভাসছে। ৩৪ বছর বয়সী বাবর আলী পেশায় চিকিৎসক। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি এমবিবিএস ডিগ্রি নেন। কিছুদিন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করলেও পাহাড়ে অভিযানের সময় ছুটি না মেলায় চাকরি ছেড়ে দেন। মূলত পর্বতজয়ের নেশা তাকে পেয়ে বসে। নিজের ফেসবুকে তিনি নিজের পরিচয় দেন এভাবে, ‘পেশায় ডাক্তার, নেশায় পাহাড়ি’। এই নেশার কারণে বাবর এখনো বিয়েটা করার সময় পাননি।
হাটহাজারীর ১৫ নং বুড়িশ্চর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের বাদশা মিয়া সিপাহির বাড়ির সাবেক কুয়েত প্রবাসী লেয়াকত আলী ও গৃহিনী লুৎফুন্নাহার বেগম দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান বাবরের জন্ম ১৯৯০ সালের ১৬ অক্টোবর। তার বড় ভাই ব্যারিস্টার মামুন আলী সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। ছোট বোন হামিমুন তানজীন কঙবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ছোট ভাই আমীর আলী বিকাশের মার্চেন্ট ডেভেলপমেন্ট এঙিকিউটিভ।
১৪ বছর আগে ট্রেকিং শুরু করেন বাবর আলী। ২০১০ সাল থেকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে ট্রেকিং করতেন। চট্টগ্রামের পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমারসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। এই ক্লাবের হয়ে ২০১৪ সাল থেকে নিয়মিত হিমালয়ের নানা শিখরে অভিযানে যান। নেপাল হয়ে চাটগাঁইয়া প্রথম হিসেবে তিনি ২০১৪ সালে কেয়াঞ্জিন রি (১৫,৬৮২ ফুট) শৃঙ্গ জয় করেন। ওই বছর তিনি সারগো রি (১৬,৩৭১ ফুট) সুরিয়া পিক (১৬,৮৮০ ফুট) পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন। ২০১৬ সালে তিনি ভারতের মাউন্ট ইয়ানাম (২০,০৬৬ ফুট) জয় করেন।
২০১৭ সালে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের উত্তরকাশী শহরের নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ নিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ওই বছর তিনি ভারতের মাউন্ট ফাব্রাং (২০,২৫০ ফুট) পর্বতে আরোহণ করেন। ২০১৯ সালে তিনি ভারতের মাউন্ট সিসিকেএন (২০,৬৮০ ফুট), মাউন্ট শিবা (২০,১৫০ ফুট) এবং মাউন্ট রামজাক (২০,৭২৮ ফুট) জয় করেন। ২০২২ সালে নেপাল থেকে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম ও টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম (২২,৩৪৯ ফুট) পর্বতে আরোহণ করেন। পরের বছর ২০২৩ নেপালের চুলু ফার–ইস্ট (১৯,৮৭৯ ফুট) এবং চুলু ইস্ট (২১,৬০১ ফুট) পর্বত জয় করেন। এক বছরের মাথায় গতকাল জয় করলেন হিমালয়ের এভারেস্ট।
নেপালের স্নোয়ি হরাইজন নামক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই অভিযানে বাবরের সঙ্গে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং পর্বতারোহণ গাইড বীর বাহাদুর তামাং। গতকাল ভোরের প্রথম কিরণে ২৯,০৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্ট শীর্ষে বাবর উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা। প্রথম চাটগাঁইয়া হিসেবে বাবর চট্টগ্রামকে নিয়ে যান এভারেস্ট চূড়ায়।
ডা. বাবর আলীর এভারেস্ট অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফারহান জামান গতকাল আজাদীকে জানান, বাবর আলী বাংলাদেশ থেকে নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন ১ এপ্রিল। নেপালের কাঠমান্ডুতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে তিন দিন পর ৪ এপ্রিল তিনি বিমানে পৌঁছে যান পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর লুকলাতে। লুকলা থেকে পথচলা শুরু করে ১০ এপ্রিল পৌঁছে যান এভারেস্ট বেসক্যাম্পে। এভারেস্ট অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো একাধিকবার উচ্চতায় ওঠানামা করে উচ্চতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া। কিন্তু কয়েকদিন অপেক্ষার পরও নেপালের দায়িত্বরত দল পথ তৈরি করতে পারেনি। তাই বাবর বিকল্প বেছে নেন। ১৬ এপ্রিল সামিট করেন ২০,০৭৫ ফুট উচ্চতার লবুচে ইস্ট পর্বত। এরপর আবার বেসক্যাম্পে ফিরে পর্বতের নিচ অংশের পথ খুলে গেলে ২৬ এপ্রিল বেসক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে ক্যাম্প–২ পর্যন্ত ঘুরে এসে শেষ করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব।
তিনি বলেন, এরপর শুরু হয় দীর্ঘ অপেক্ষা। শুভাকাঙ্ক্ষী আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশের কাছ থেকে জানা গেল ১৯ থেকে ২১ এপ্রিল চূড়ার পরিবেশ কিছুটা শান্ত থাকবে। এরপর ১৪ এপ্রিল মাঝরাতে বেসক্যাম্প থেকে শুরু হয় বাবরের স্বপ্নের পথে যাত্রা। প্রথম দিনেই সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প–২ এ, যার উচ্চতা ২১,৩০০ ফুট। পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর ১৮ মে উঠে আসেন ২৪,৫০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প–৩ এ। ক্যাম্প–৪ এ আসেন ১৯ মে। ২৬,০০০ ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের উপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন। ১৮ মে মাঝরাতে আবার শুরু হয় বাবরের যাত্রা। অবশেষে গতকাল সকালে বাবরের হাতে ধরা দেয় স্বপ্নের সূর্য, মাউন্ট এভারেস্ট জয়।
উচ্ছ্বসিত ফরহান জামান জানান, বাবরের অভিযান এখানেই শেষ নয়। বাবরের আসল লক্ষ্য এভারেস্টের লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎসে। সেটি জয় করে তিনি ফিরে আসবেন।
উল্লেখ্য, লোৎসেতে এর আগে কোনো বাংলাদেশি যাননি এবং কোনো বাংলাদেশি একই অভিযানে দুটি আট হাজারী শৃঙ্গে চড়েননি। তাই লক্ষ্য পূরণ হলে চাটগাঁইয়া বাবর আলী বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করবেন।
ফরহান জামান বলেন, বাবর আলীর এই সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি চট্টগ্রামের তথা পুরো দেশের সব মানুষের জন্যই এক অনন্য অর্জন। এটি আমাদের দেশের তরুণদের আরো বড় স্বপ্ন দেখার এবং তা পূরণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। এই অভিযানের পেছনে ছিল অসংখ্য মানুষের অবদান। আমরা তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই।
পর্বতারোহণ বাবরের নেশা হলেও সাইক্লিং, ম্যারাথন, স্কুবা ডাইভিংয়ের মতো অ্যাডভেঞ্চার অ্যাক্টিভিটিতেও তিনি নিয়মিত জড়িত ছিলেন। অ্যাডভেঞ্চারের তাড়নায় পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন দেশের ৬৪ জেলা, সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন ভারতের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর পথ। বান্দরবান থেকে হিমালয়, সুন্দরবন থেকে দক্ষিণ ভারত, যে জনপদেই তিনি গেছেন, সাক্ষী হয়েছেন অভূতপূর্ব কিছু মুহূর্তের। প্রকৃতির প্রতি তার এই ভালোবাসা এবং বিস্ময়ে প্রতিনিয়ত তিনি ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে। সেই সূত্র ধরেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া থেকে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন পূরণ করেছেন তিনি।
এই অভিযানের মোট ৪৫ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে জানিয়ে ফরহান জামান বলেন, বাবরের এই অভিযানে মূল পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে ভিজ্যুয়াল নীটওয়্যার লিমিটেড। এছাড়া সহ–পৃষ্ঠপোষক ছিল এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব, বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ব্লু জে, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনী, গিরি ও ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। এছাড়া অভিযানের জন্য গণ–তহবিল সংগ্রহে অংশ নিয়েছেন দেশে–বিদেশে নানা সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠন এবং অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী। অভিযানের সার্বিক সমন্বয় করেছে ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।
বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের নাম এভারেস্ট পর্বত বা মাউন্ট এভারেস্ট। নেপালি ভাষায় এর নাম সাগরমাথা, তিব্বতিতে চোমোলুংমা। পর্বতটির অবস্থান হিমালয়ের মহালঙ্গুর হিমাল পর্বতমালায়। পর্বতটির চূড়া চীন ও নেপালকে আলাদা করেছে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০১০ সালের ২৩ মে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম। নারীদের মধ্যে প্রথম বাংলাদেশি এভারেস্টজয়ী হচ্ছেন নিশাত মজুমদার। তিনি ১৯ মে ২০১২ সালে এভারেস্ট জয় করেন। বাবরের আগে মোট পাঁচজন বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেছেন। তারা হলেন মুসা ইব্রাহীম, এম এ মুহিত, নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরীন। এছাড়া ২০১৩ সালে মো. খালেদ হোসাইন এভারেস্ট জয় করে ফিরে আসার পথে ডেথ জোনে ছিটকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মরদেহের খোঁজ আজও মেলেনি। বিশ্বে বাংলাদেশ ৬৭তম এভারেস্টজয়ী দেশ।