এবং বিশ্বজিৎ

একজন গায়কের বেড়ে ওঠার কথকতা

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ২১ অক্টোবর, ২০২৪ at ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের শিল্পীদের জীবন যেমন বর্ণিল তেমনই অনিশ্চিত। আমার জীবনের নানান ঘাতপ্রতিঘাত, চড়াইউতরাইয়ের গল্প উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। আশা করি আমাকে যারা ভালোবাসেন তাদের ভালো লাগবে আমার জানাঅজানা গল্পগুলো…”

এবং বিশ্বজিৎ” নামের এই আত্মকথনমূলক আত্মজৈবনিক বইয়ের শুরুতেই লিখেছেন গত চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশের গানের জগতের কথা কিংবদন্তি শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ।

আসলে তারকা জগতের মানুষগুলোকে আমরা দূর থেকে তারা হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, একেক জন। অথচ তাঁদের এই তারকা হয়ে উঠা, টিকে থাকা, তাঁদের সংগ্রামের কথাআমরা কিন্তু জানি না। শুধু তারকাখ্যাতিকে আমরা দেখি। আবার যখন তারকার আলো মিলিয়ে যায়, আর খবরও রাখি না। এটাই চরম বাস্তবতা। তাই বাংলা গানের জগত চার দশক ধরে রাজত্ব করা গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ এভাবেই বর্ণনা করে জানিয়ে দিলেন তাঁর জীবনের চড়াইউতরাই, ঘাতপ্রতিঘাতের নানা ঘটনাপ্রবাহ। যারা বাংলা গানের ভক্ত বা অনুরাগী, আমরা জানি কয়েক প্রজন্ম ধরে কুমার বিশ্বজিৎ গাইছেন এবং জনপ্রিয় তারকাশিল্পী। এটা তো আর দুই / তিন /চার বছরে হয়নি। অনেক বছরের সাধনার ফল। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জন্মে, একজন গানের শিল্পী কীভাবে তারকা হয়ে উঠলো। কীভাবে একজন কুমার বিশ্বজিৎ নিজেই ব্র্যান্ড হলেন। আমরা আাশির দশক থেকেই এই শিল্পীর ভক্ত। তাই এই আগ্রহ সবসময়ই ছিল বিশ্বদার শিল্পীজীবনের কথা জানার। সাধারণত তারকা শিল্পীরা নিজেদের জীবনকে প্রকাশ্যে আনতে চান না। রহস্যে ঘিরে রাখতে চান। ব্যতিক্রমী ধারায় ও যথেষ্ট সাহসে অকপটে বলে গেলেন শিল্পী তাঁর জীবনের কথা। তারকা হয়ে উঠার কথা।

শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ বেশ কয়েকটি পর্বে বইটিতে তাঁর কথা বলেছেন। পর্বগুলো পড়লেই আপনিও জানতে পারবেন আজকের ‘কুমার বিশ্বজিৎ’ হয়ে উঠার কাহিনী। পর্বগুলো হচ্ছে: গল্পের শুরু, একাত্তরের দিনগুলি, চট্টগ্রামে নতুন জীবন, রিদম সেভেন্টি সেভেন থেকে ফিলিংস, প্রথম গান রেকর্ডিং, সিনেমার গানে অভিষেক, ঢাকায় টিকে থাকার সংগ্রাম, সিনেমার গানের অলিগলি, প্রথম অ্যালবাম, প্রথম স্বপ্ন, যেখানে সীমান্ত তোমার, আরও গানের গল্প, সেকাল বনাম একাল, তপন চৌধুরী: বন্ধু তুমি শত্রু তুমি, অন্য আমি, বাচ্চু আমার বন্ধু, স্মৃতির পালকি, বাবামায়ের প্রস্থান, সংসার জীবন, শেষ বলে কিছু নেই। আর এই পর্বগুলোর সাথে যুক্ত আছে “স্মৃতির অ্যালবাম” শিরোনামে দুর্লভ আলোকচিত্রের সমাহার।

এবং বিশ্বজিৎ” বইয়ের আলোচনা লিখতে গিয়ে টের পেলাম, পাতায় পাতায় চমকপ্রদ ঘটনা। পুরো বইটি পারলে তুলে ধরি এই অবস্থা আমার। কোনটা ফেলে কোনটা বলি।

একাত্তরের দিনগুলি” পর্বে তিনি বললেন, “যুদ্ধের ঠিক পরপর মুক্তিযোদ্ধা মফিজ কাকুসহ অন্যরা পাঁচ ছয়জন পাক আর্মিকে আটকে রেখেছিল আমাদের এলাকার একটা ল্যাবরেটরির হলরুমে। রাস্তায় আসা যাওয়ার পথে জানালা দিয়ে তাদের দেখা যেত। ওই যে যুদ্ধে যেতে পারি নাইসেই খেদ ছিল নিজের মধ্যে। প্রায় সাতআটদিন চেষ্টার পর জানালা খোলা পেয়ে পাথর মেরে এক পাক আর্মির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। মনের ভেতর পাক হানাদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ তা মিটিয়েছিলাম সেদিন কিছুটা।” এই হলো কিশোর বিশ্বজিতের একাত্তর সালের অনেকগুলোর মধ্যে একটা চমকপ্রদ ঘটনা ।

অনেক কষ্ট আর সাধনায় একজন শিল্পী নিজেকে গড়ে তোলেন। সেই কষ্ট অনেকে সহ্য করতে না পেরে দূরে সরে গেছেন। কিন্তু বিশ্বদা সরে যাননি। নানান কষ্টের মাঝেও গানের চর্চা করে গেছেন নিরলসভাবে, ঐকান্তিকতার সাথে। সেই কষ্টের ছোট্ট একটা নমুনা তুলে ধরি তাঁর “রিদম সেভেন্টি সেভেন থেকে ফিলিংস” পর্ব থেকে… “কী অসহ্য গরমে আমরা সেখানে প্র্যাক্‌টিস করতাম। এসি নাই। স্টোর রুম; চারপাশ বন্ধ। কিন্তু প্র্যাক্‌টিস তো করতে হবে। প্র্যাক্‌টিস শেষে ফেরার সময় কমার্স কলেজের পাশে একটা কলের পানি খেতাম আমি আর বাচ্চু। কারণ এত ঘামতাম যে পানিশূন্যতায় খুব খারাপ অবস্থা থাকতো। প্রচুর পানি খেয়ে আমরা ফিরতাম জুবিলি রোডের বাসায়। এই ছিল আমাদের গড়ে ওঠার দিনগুলো।” বিশ্বদা আর বাচ্চু ভাই তখন ফিলিংস ব্যান্ডে। হোটেল আগ্রাবাদের এক স্টোর রুমে প্র্যাক্‌টিস করার সুযোগ পেলেন। সেই দিনের কষ্ট সহ্য করা দুই শিল্পী হলেন কুমার বিশ্বজিৎ এবং আইয়ুব বাচ্চু। দুইজনই কিংবদন্তি শিল্পী। পাঠক, ভাবতে পারেন তাঁদের গানের প্রতি একাগ্রতার কথা, সংগ্রামের কথা।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে কী কী ধরনের ঝুঁকি সামলিয়েছেন তা অকপটে বলেছেন বিশ্বদা। বাসা ভাড়া বা থাকার জায়গা নিয়ে বিড়ম্বনার কথাও বলেছেন “ঢাকায় টিকে থাকার সংগ্রাম” পর্বে। বললেন: “বসিয়ে চা খাওয়ায়, কিন্তু বাসা ভাড়া দেয় না।পরে আমাকে উদ্ধার করলেন পাশা ভাই। সদরুল পাশা। উনি ওনার অ্যাড ফার্মেও বিল্ডিংয়ের ছাদে আমার বাসা খুঁজে দিলেন।ঢাকায় আমার থিতু হবার পেছনে আলাউদ্দিন আলীর অনেক অবদান আছে। কারণ তিনি খেয়াল রাখতেন আমার বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচ আমি যোগাতে পারছি কি না।বাসায় ফ্রিজ ছিল না। বুয়া রান্না করে টেবিলে রেখে যেতেন। বাসায় ফিরতে যেদিন দেরি হতো, খাবার নষ্ট হয়ে যেত। রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তাম। সারারাত অভুক্ত থেকেই সকালে উঠে আবার কাজে যেতাম।এভাবেই বেঁচে থাকার সংগ্রামে আমরা দিন কাটিয়েছি ভালোমন্দ মিলিয়ে। কিন্তু স্বপ্নচ্যুত হইনি কখনো। যাই হোক, এভাবেই একটু একটু করে নিজের জায়গা করে নিতে থাকলাম। গানের টানে ঢাকায় আসা আমি আস্তে আস্তে থিতু হতে থাকলাম এই ব্যস্ত শহরে।”

১৯৮২তে প্রথম অ্যালবাম হলো। একটা স্বপ্নের বাস্তবায়ন! সেই সময়টাতেই সিনেমার গানেও সুযোগ পাই। টিভিতে নিয়মিত গাইছি। প্রথম ক্যাসেট হিট। তাই সব মিলিয়ে বলা যায় ১৯৮২ সাল আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট।১৯৯১ সালে জাপানে টোকিয়োর কিটা উরাওয়া পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে বাপ্পী লাহিড়ী মোড়ক উন্মোচন করেন আমার প্রথম অডিয়ো সিডির। প্রযোজনা করেছিল মিরর অডিয়ো ভিশন। আর আমার প্রথম ডিভিডি প্রকাশ পায় ১৯৯৯ সালে আমেরিকা থেকে। প্রকাশ করেছিল মুক্তধারা। ঘটনাচক্রে এই সিডি ও ডিভিডি দুটোই যেকোনো বাংলাদেশী শিল্পীর জন্য প্রথম।”এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকলেন একজন গায়ক।

বাংলাদেশের গানের জগতে চট্টগ্রামের তিন কিংবদন্তি শিল্পীতপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ,আইয়ুব বাচ্চু। এই তিনজনের অগুনিত ভক্ত। এই তিনজনের সম্পর্ক নিয়ে কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। যাঁরা এঁদের ঘনিষ্ঠ জন, তাঁরা জানেনএই তিন শিল্পীর বন্ধন কতটা মজবুত। কতটা আনন্দের। “তপন চৌধুরীঃ বন্ধু তুমি শত্রু তুমি” পর্বে লিখেছেনআমার আর তপনদার জনপ্রিয়তার বিষয়টা অনেকটা তখনকার মোহামেডানআবাহনীর মতো ছিল।কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটা সবসময় খুবই সুন্দর। সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তপনদার সাথে সম্পর্ক বড়ো ভাইছোটো ভাইয়ের মতো।” তেমনই করে “বাচ্চু আমার বন্ধু” পর্বে বিশ্বদা লিখেছেন– “বাচ্চুর সাথে আমার বন্ধনটা শুধু মিউজিকের না। আমাদের বন্ধনটা বন্ধুত্বের, ভ্রাতৃত্বের। সেই ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু। একসাথে ব্যান্ড করেছি। গানের শুরু, শেখা,অনুশীলন, ঢাকায় আসা, কষ্ট করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। এই সবকিছু একসাথে।বাচ্চুর প্রেম ছিল গিটারের সাথে। যখনই বিদেশ যেতাম শো করতে, ঠিকই একটা করে গিটার কিনে ফেলতো। আমি বলতাম, “তোর এত গিটার, আবার কেন কিনিস? ওর কথা, ভালো লাগে।”…. শেষ সময়টায় দেখা হলে আমি অভিমান নিয়েই বলতাম, আমার বাসায় আর আসিস না। দরকার নাই। ও তখন বলতো, “দোস্তো আমি আর তুইই তো। হয় আমি তোকে কাঁধে নিবো না হয় তুই আমাকে। শেষ পর্যন্ত সেই বাচ্চুকে আমিই নিলাম কাঁধে।”

এমন করেই শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ লিখেছেন তাঁর জীবনকথা। কত বৈচিত্র্যময়, কত সুখদুঃখে বেড়ে উঠা, গানের জগতে তারকাখ্যাতি পাওয়া। এমন খ্যাতি যে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে, তাও অকপটে জানিয়েছেন। “বাবামায়ের প্রস্থান” পর্বে লিখেছেন: “মাইক্রোতে করে চট্টগ্রামে যখন বাবার মরদেহ নিয়ে ফিরছি তখন হলো আরেক অভিজ্ঞতা। ফেরিঘাটে অপেক্ষা করছি ফেরি আসার জন্য। আমাকে দেখে লোকের ভিড় হয়ে গেল। সেই ভিড়ের সুবিধা নিয়ে ব্যবসা করতে পাশের স্টুডিয়ো থেকে ফটোগ্রাফার চলে আসলো। মানুষ আমার সাথে ছবি তুলতে চায়। আমি বললাম, আমার বাবার মরদেহ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। ছবি তোলার মতো মন মানসিকতা নেই। কে শোনে কার কথা! মা বললেন, তোল ছবি। মানুষ তোকে ভালোবাসে। তোর বাবা হয়তো খুশি হবেন। সেদিন বুঝলাম, আমরা শিল্পীরা আসলে আমাদের নিজেদের আর থাকি না একটা সময়ের পর। তাই আমাদের কোনো ব্যক্তিজীবন থাকে না। সব বিলিয়ে দিতে হয় মানুষের তরে।”

এবং বিশ্বজিৎ” এভাবেই লেখা হয়েছে। পাঠক এই বইটি পাঠে অনেক অজানা তথ্য জানবেন। আমাদের জন্য এই দুরূহ কাজটি করেছেন জয় শাহরিয়ার। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে এই কিংবদন্তি শিল্পীর কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। তারপর প্রকাশ করেছেন। জয় শাহরিয়ারকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

পরিশেষে আমাদের প্রিয় শিল্পী ও মানুষ কুমার বিশ্বজিৎকে জানাই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শুভকামনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধষড়ঋতুর চাটগাঁইয়া গান
পরবর্তী নিবন্ধপূর্ব নলুয়ায় পুরস্কার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান