এক সিদ্ধান্তেই বেঁচে যাচ্ছে অন্তত চারশ’ কোটি টাকা। টাকার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে ‘সময়’। গণমুখী এক সিদ্ধান্তেই নগরীর বহুল প্রত্যাশার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কার্যক্রম প্রত্যাশারও বেশি গতিতে সম্পন্ন হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে। এরফলে নগরীর বহুল প্রত্যাশার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির বারিকবিল্ডিং থেকে কাস্টমস ব্রিজ পর্যন্ত এলাকার ডিজাইন আর পাল্টানো হচ্ছে না। পূর্বের ডিজাইনে রাস্তার উপর দিয়েই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। এতে অন্তত ২৫টি বহুতল ভবন নিশ্চিত ভাঙার কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নগরীর যান চলাচলে ব্যাপক গতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সন্নিকটস্থ টানেল রোড পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। মাত্র ত্রিশ মিনিটে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর মতো বৈপ্লবিক গতি আনার স্বপ্ন নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। পাঁচটি পৃথক ধাপে ভাগ করে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এরমধ্যে লালখান বাজার-বারেক বিল্ডিং পর্যন্ত প্রথম ধাপ, বারেক বিল্ডিং-সল্টগোলা ক্রসিং দ্বিতীয় ধাপ, সল্টগোলা ক্রসিং-সিমেন্ট ক্রসিং তৃতীয় ধাপ, সিমেন্ট ক্রসিং-কাঠগড় চতুর্থ ধাপ এবং কাঠগড় থেকে পতেঙ্গার ল্যান্ডিং পয়েন্ট পর্যন্ত পঞ্চম ধাপ চিহ্নিত করা হয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল শেষ ধাপ থেকে। বর্তমানে ল্যান্ডিং পয়েন্ট থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত দুইটি ধাপের (৪র্থ ও ৫ম) কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই দুই ধাপে গার্ডার স্থাপনের কাজ চলছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ফ্লাইওভারের এই অংশের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে গতকাল জানিয়েছেন। প্রকল্পের তৃতীয় ধাপ সল্টগোলা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত অংশের কাজও জোরেশোরে চলছে। এই অংশটিতে প্রকল্পের কাজ ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের কাজ বেশ দ্রুত গতিতে অগ্রসর হলেও দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত এলাকার কাজ করতে গিয়ে বড় ধরনের সংকটে পড়ে সিডিএ। এই অংশটিতে রাস্তার উপর দিয়ে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে নির্মানের ডিজাইন করা হয়েছিল শুরুতে। কিন্তু কাজ শুরু করতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আপত্তির কবলে পড়ে সিডিএ। বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের আপত্তি জানিয়ে বলে, ‘বিমানবন্দর সড়কের এই অংশটিতে বিদ্যমান সড়কের উপর এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে তা বন্দরের সার্বিক কার্যক্রমের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠবে। সড়কের মাঝ দিয়ে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে গেলে বন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আইএসপিএস কোড অনুযায়ী বন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যও বন্দর কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করে।’ বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বারিক বিল্ডং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে বিদ্যমান সড়কের উপর নির্মাণ না করে ত্রিশ ফুট বাইরে দিয়ে নতুন এ্যালাইমেন্ট তৈরি করা হয়। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সাত একর এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন পাঁচ একর মিলে মোট ১২ একর জায়গা হুকুম দখল এবং অন্তত ২৫টি বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় চারশ’ কোটি টাকারও বেশি বেড়ে যাচ্ছিল। টাকার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছিল ভবন ভাঙ্গা। এতগুলো বহুতল ভবন ভেঙ্গে রাস্তার বাইরে ত্রিশ ফুট দূর দিয়ে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে নির্মাণ একটি কঠিন ব্যাপার হয়ে উঠে। এতে কয়েক বছর সময় লেগে যাওয়ারও আশংকা তৈরি হয়।
কিন্তু বন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নতুন ডিজাইনে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে নির্মাণে অগ্রসর হতে থাকে। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রনালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের শীর্ষ নেতাদের একটি টিম চট্টগ্রামে এসে সরেজমিন সবকিছু দেখে গেছেন।
গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক সভা করে। বন্দর ভবনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল এম মোজাম্মেল হক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আলহাজ জহিরুল আলম দোভাষ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষে সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড এডমিন) মোহাম্মদ জাফর আলম, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস, প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমানসহ বন্দর এবং সিডিএর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিকেল তিনটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত প্রকল্পটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এতে প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নগরীর বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত অনুমোদিত ডিপিপি-তে প্রেরিত নকশা অনুযায়ী মূল রাস্তার মধ্যখানে পিলার স্থাপনের মাধ্যমে ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রথম ডিজাইন বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্তের ফলে বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত এলাকায় অন্তত ২৫টি বহুতল ভবন ভাঙ্গার কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রায় চার একর এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন আড়াই একর জমি অধিগ্রহন করতে হবে না। স্থাপনা বাবদ কোনো ক্ষতিপূরণই দিতে হবে না। এতে ভবনগুলোর ক্ষতিপূরণ এবং ভূমি অধিগ্রহনের মূল্য বাবদ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অন্তত চারশ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। একই সাথে অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু এবং শেষ করা সম্ভব হবে। গতকালের বৈঠকে আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, নির্মাণকাজ চলাকালীন রাস্তার দু’দিকে দুই লেইন করে মোট চার লেইন ফ্রি রাখতে হবে। ফ্লাইওভারের যে পাশে কেপিআই এলাকা থাকবে সেই পাশে নিরাপত্তা নিম্িচতকল্পে শব্দ নিরোধক উঁচু ফেন্সিং তৈরী করতে হবে। নির্মাণকালীন সময়ে সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর এবং বাংলাদেশ পুলিশ এর ট্রাফিক বিভাগের সাথে সমন্বয় করতে হবে। বন্দরের বিদ্যমান গেইটসমূহে চলাচলকারী ট্রাক/লরি প্রয়োজনে সিপিএআর গেইটে সাময়িক শিফট করা হবে। বন্দরের বিদ্যামান গেইটসমূহের সম্মুখে যাতে কোনো পিলার স্থাপিত না হয় সেজন্য প্রয়োজনে স্প্যানের দূরত্ব সমন্বয় করতে হবে।
নতুন সিদ্ধান্তের ফলে কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকছে না বলে উল্লেখ করে গতকাল সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস এবং প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান দৈনিক আজাদীকে জানান, আমরা বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত এলাকাকে আবারো চার ভাগে ভাগ করে কাজ করবো। এখানে ৪১টি পিলার হবে। আমরা দশটি করে পিলারের কাজ ধরবো। একটি অংশে আড়াই মাস করে সময় লাগবে। চারটি অংশে দশ মাসে কাজ শেষ হবে। অথচ নতুন এ্যালাইমেন্ট করতে গেলে কখন যে কাজ শেষ হতো কে জানে! বন্দর কর্তৃপক্ষের নবাগত চেয়ারম্যানসহ বোর্ড সদস্যদের ভূমিকার প্রশংসা করে সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চট্টগ্রামের স্বার্থেই এমন গণমুখী একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যার সুফল চট্টগ্রামের মানুষ অচিরেই পাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড এডমিন) মোহাম্মদ জাফর আলম বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা বিষয়টি নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে এসেছি। এটি আসলে প্রয়োজন ছিল। এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহনের ফলেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের শুধু টাকাই সাশ্রয় নয়, বহু সময়ও সাশ্রয় হবে। একটি প্রকল্পের জন্য টাকার চেয়ে সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, মানুষের যাতে ভোগান্তি না হয় তা নিশ্চিত করতেও সিডিএকে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বহুল প্রত্যাশিত প্রকল্পটি গত ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির ৪০ শতাংশেরও বেশি সম্পন্ন হয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান।