আনোয়ারায় জ্বর–সর্দি ও চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নারী শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের সাধারণ মানুষ। হাসপাতালের বেড ও বহির্বিভাগে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক মাসে শুধুমাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছে ২০ হাজার রোগী। উপজেলার ৪ লাখ লোকের চিকিৎসা সেবার ভরসাস্থল এই হাসপাতাল এখন নানামুখী সংকটে নাকাল অবস্থায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকা, জনবল সংকট, পর্যাপ্ত ওষুধের সরবরাহ না থাকা, ডাক্তারদের যথাসময়ে কর্মস্থলে না আসা এবং আরও বিভিন্ন অনিয়মে সরকারি এই হাসপাতালটি নিজেই যেন এখন কঠিন রোগে আক্রান্ত। উপজেলার ১১ ইউনিয়ন ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বাঁশখালী ও চন্দনাইশের একাংশের মানুষের চিকিৎসায় ভরসা আনোয়ারা হাসপাতাল। ভৌগলিক অবস্থান ও যাতায়াত সুবিধার কারণে এখানে বরাবরই রোগীর ভিড় থাকে বেশি। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন নিজেই রোগী। ফলে সেবা–প্রার্থীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অনেকটা অসহায়। গত কয়েক মাস ধরে উপজেলাজুড়ে ঘরে ঘরে জ্বর–সর্দি ও এলার্জিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন এসব রোগের উপসর্গ নিয়ে আনোয়ারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ছুটে আসেন সাধারণ মানুষ। উন্নতমানের চিকিৎসা সেবার প্রত্যাশা নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে ছুটে আসলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা না পেয়ে ফিরে যান হতাশ হয়ে। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাছাড়া পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ না থাকা, হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সংকট এবং ডাক্তাররা যথাসময়ে কর্মস্থলে আসা–যাওয়ার নিয়ম না মানা, বিভিন্ন বিভাগে জনবল সংকটসহ নানা কারণে ভালো মানের চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার অভিযোগ সেবা–প্রার্থীদের।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত এক মাসে হাসপাতালের বর্হিবিভাগে ১৪ হাজার ৬৫৮ রোগী, জরুরি বিভাগে ৪ হাজার ৬৮ জন আর হাসপাতালের বেড়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৫৯ জন রোগী। তাদের মধ্যে অধিকাংশ রোগী জ্বর, সর্দি আর চর্ম রোগে আক্রান্ত। বর্তমানে রোগীর চাপ এত বেশি ডাক্তারদের তা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জানা যায়, বর্তমানে হাসপাতালের ৮ জন মেডিকেল অফিসার পদের মধ্যে ৫ জন অফিসার কর্মরত আছেন। বাকি তিনজনের মধ্যে দুইজন চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন অনেক বছর আগে, কিন্তু এখনো পদ দুটি শূন্য বলে ঘোষণা করেনি কর্তৃপক্ষ। যার কারণে তাদের স্থলে কোনো ডাক্তার যোগদানেরও সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জুনিয়র কনসালটেন্ট অর্থপেডিক সার্জারি ও জুনিয়র কনসালটেন্ট চর্ম ও যৌন রোগ পদ শূন্য অনেকদিন ধরে। আর জুনিয়র কনসালটেন্ট কার্ডিওলজি চমেক হাসপাতালে সংযুক্তিতে রয়েছেন।
এছাড়া তৃতীয় শ্রেণীর ৮৪টি পদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক, ক্যাশিয়ার, অফিস সহকারী তিন পদের মধ্যে ২টি শূন্য, সহকারী নার্স পদে ১ জন নেই, সহকারী ডেন্টাল সার্জন ১ জন, ইউনিয়ন সাব–সেন্টার সহকারী সার্জন ২ জন, উপ–সহকারী মেডিকেল অফিসার ২ পদের মধ্যে ২টি শূন্য, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (এঙরে) ১ পদ শূন্য, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ল্যাব ৩ পদে ২ জন নেই, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ইপিআই ১ পদ শূন্য, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ফিজিও পদ শূন্য, যক্ষা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ সহকারী পদে কেউ নেই, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শকের ১টি পদ শূন্য, স্বাস্থ্য সহকারীর ৪৫ পদের মধ্যে ৮টি শূন্য, ড্রাইভার পদ শূন্য। জুনিয়র মেকানিক পদসহ ৮৪টি পদের মধ্যে ২৬ পদে কোনো লোক নেই। চতুর্থ শ্রেণীর ২৩ পদের মধ্যে কুক দুইটি, নিরাপত্তা প্রহরী ২ পদ শূন্য, আয়া দুই পদে আছেন ১ জন, ওয়ার্ড বয় ৩ পদের মধ্যে ১ পদ শূন্য, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পাঁচ পদের মধ্যে দুটি পদ শূন্য, অফিস সহায়ক চারটি পদের মধ্যে ৪টিই শূন্য, গার্ডেনার পদ শূন্য সহ ১২ পদে কোনো জনবল নেই। জনবল সংকটে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়েছে।
গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় বারখাইন জমিরিয়া চিসতিয়া হেফজ বিভাগের ৮ শিক্ষার্থী একসাথে চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। তারা জানায়, আমরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে এসেছি। আমাদের হাসপাতাল থেকে তেমন কোনো ওষুধ দেয়নি।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা উপকূলীয় রায়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দা নুর নাহার বলেন, জ্বর সর্দি নিয়ে হাসপাতালে আমি ও আমার ছেলে এসেছি। ডাক্তার দেখে দুই পাতা প্যারাসিটামল দিল। হাসপাতালে আসা যাওয়াতে আমাদের গাড়ি ভাড়া লাগে ২০০ টাকার বেশি।
আনোয়ারার বাসিন্দা ব্যবসায়ী শরীফ নেওয়াজ সাকিলের অভিযোগ, আনোয়ারা হাসপাতালে উন্নতমানের কিংবা জরুরি কোনো স্বাস্থ্য সেবা নেই। বিকালে কিংবা রাতে ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাছাড়া, ডাক্তাররা আসা–যাওয়ায় নির্ধারিত টাইম মানেন না।
আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরী জানান, আমি যোগদানের পর থেকে হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও জনবল সংকটের কারণে পর্যাপ্ত সেবা দেওয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে জনবল সংকটের কারণেও আমরা সমস্যায় আছি। তারপরও সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি রোগীদের।
বর্তমানে জ্বর–সর্দি ও চর্ম রোগের প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে তিনি জানান, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে জ্বর–সর্দির প্রভাব বেড়েছে। এলাকার ঘরে ঘরে সাধারণ মানুষ জ্বর–সর্দি ও এলার্জিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি জ্বর সর্দিতে আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়ার অনুরোধ জানান। সেই সাথে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, বেশি করে পানি পান, লেবু, মাল্টা, ডাব জাতীয় বিভিন্ন ফল খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।