অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে স্বর্ণের দাম। তাই স্বাভাবিকভাবে বাজারে স্বর্ণের তৈরি বিভিন্ন গহনা–অলঙ্কারের বেচাবিক্রিও কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিগত এক বছর ধরে স্বর্ণের ব্যবসায় মন্দাভাব চলছে। দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারা আগের মতো স্বর্ণ কিনতে পারছেন না। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ইউক্রেন–রাশিয়া ও ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকে। এর প্রভাবে গত এক বছরে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) ৩৮ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করেছে। এর মধ্যে ২৪ বারই দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৯ সেপ্টেম্বর স্বর্ণের দামের সমন্বয় করা হয়। শুধু ওই মাসে ৫ বার দাম সমন্বয় করা হয়েছে, এরমধ্যে বেড়েছে ৪ বার। ওই চারবারে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিতে দাম বেড়েছে ১০ হাজার ৭৬৬ টাকা। এছাড়া কমেছে মাত্র একবার। তাও ভরিতে মাত্র ১ হাজার ২৫৯ টাকা। বর্তমানে দেশের বাজারে ভালো মানের ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৪৯ টাকা।
স্বর্ণালঙ্কার ও জুয়েলারির বড় বাজার নগরীর নিউমার্কেট বিপনী বিতান ঘুরে দেখা গেছে, জুয়েলারি শপগুলোতে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। ক্রেতার অপেক্ষায় অনেকে অলস সময় পার করছেন। বিক্রেতারা বলছেন, স্বর্ণের দাম বাড়ার পর থেকে বেচাবিক্রি মন্দা। তবে কিছু কিছু ছোট গহনা–অলঙ্কার বিক্রি হচ্ছে। সেগুলোতে মুনাফাও অত্যন্ত কম।
জানা গেছে, বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির জন্য কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায়। তবে আমদানিতে কিছু জটিলতা হচ্ছে– এমন অভিযোগ এনে ওই ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ আমদানি বন্ধ করে দেন। বর্তমানে কাস্টমস ব্যাগেজ রুলসের আওতায় কিছু স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে। তবে দেশের বাজারে এখনো বেশিরভাগ স্বর্ণই আসছে অবৈধ পথে। অনেক সময় বিমানবন্দর থেকে কাস্টমস ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা স্বর্ণের বড় ছোট অনেক চালান আটক করে। এছাড়া স্বর্ণকে বিভিন্ন কৌশলে প্রক্রিয়া করে আনার সময়ও ধরা পড়ার ঘটনা ঘটে। তবে অভিযোগ রয়েছে–কাস্টমস ও বিমানবন্দরের বিভিন্ন অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করেও দেশের বাজারে স্বর্ণ আসে।
এদিকে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি চট্টগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, স্বর্ণের দাম বাড়ার কারণে একদিকে বেচাবিক্রি কমে গেছে। অপরদিকে মুনাফাও কমে গেছে। কারণ স্বর্ণ ব্যবসায় বিনিয়োগ বেশি করতে হয়। দাম বৃদ্ধিতে বাজারের গত ৫ বছরের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে– গত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভালো মানের ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির দাম ছিল ৫৮ হাজার ২৮ টাকা, ২০২০ সালে ৬৯ হাজার ৭৬৭ টাকা, ২০২১ সালে ৬৯ হাজার টাকা, ২০২২ সালে ৭৯ হাজার ৫০০ টাকা এবং গত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২৪৩ টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক প্রণব সাহা দৈনিক আজাদীকে বলেন, স্বর্ণের দাম বাড়ার পর থেকে বেচাবিক্রির অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের সমিতির অধীনে চট্টগ্রাম বিভাগে সাড়ে ৫ হাজার দোকান আছে। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীতে আছে ২ হাজার ৮০০ দোকান। এরমধ্যে ৭০ শতাংশের অবস্থা নাজুক। অনেকের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার উপক্রম হয়েছে। আসলে স্বর্ণের দামের উঠানামা আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সম্পর্কিত। ইউক্রেন–রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ে। এছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেকে স্বর্ণ মজুদ করে রাখে। এতেও স্বর্ণের দাম বাড়ে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার কমানোর কারণে স্বর্ণের বাজারে চাপ তৈরি হয় এবং দাম বাড়ে।
জানতে চাইলে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘স্বর্ণের বাজারে আসলে সরকারি পর্যায় থেকে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নাই। এটি একটি নিয়ন্ত্রণহীন বাজার বলা চলে। নিয়ন্ত্রণ না থাকার বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি তাদের হিসেব মতো দাম বাড়ায় কিংবা কমায়। দামটা যৌক্তিক পর্যায়ে বাড়লো কিনা এটি জানার নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকা জরুরি। এখন সমিতি নিজেই যখন দাম বাড়ায়, তখন ক্রেতাদের তো সেই দামে কিনতে হবে।’