ভাবতে কষ্ট হয়, মোস্তফা কামাল পাশা ভাই নেই। তিনি আর লিখবেন না আজাদীর ‘খোলা হাওয়ায়’, লিখবেন না আর কোনো কলাম ‘উপসম্পাদকীয়’ পাতায়। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি গত ১৫ এপ্রিল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। রোগ ধরা পড়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর চলে যাওয়াকে কেমন জানি মেনে নেয়া যায় না।
আজাদীতে কাজ করার সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। তিনি আমার অগ্রজ শ্রদ্ধেয় সহকর্মী। ১৯৯১ সাল থেকে মৃত্যু অবধি তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। ১৯৯৭ সালে আজাদীর চাকরি ছেড়ে চলে গেলেও আজাদী ছাড়েন নি তিনি। প্রায় প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতই লিখে গেছেন বিরতিহীন।
মৃত্যু অমোঘ। সবাইকে মরতে হবে। কিন্তু তিনি যে মৃত্যু পথযাত্রী, বেশিদিন বাঁচবেন না, সেটা তিনি আগেই অনুমান করতে পেরেছেন। অবাক বিষয়, তিনি নিজেই লিখে গেছেন তাঁর মৃত্যু সংবাদ। ২৭ মার্চ আমাকে এবং আরো কয়েকজনকে লিখে পাঠিয়েছেন এটি। আমি তখন তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। ফোন করে কথা বলে তাঁর কষ্টের কথা অনুভব করি। তবে আশ্চর্যের বিষয়, সেই অবস্থাতেও তিনি বিন্দুমাত্র সাহস হারান নি। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন অসুস্থতার কষ্ট। প্রতিদিন ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া থেকেও বিরত থাকেন নি। ৫ এপ্রিল লিখলেন, ‘কখনো হঠাৎ যদি মনে পড়ে শুধু এক ফোঁটা হার্দিক আবেগ ছুঁড়ে দেবেন, এই অভাজনের প্রতি’। ৬ এপ্রিল লিখলেন, ‘জীবনে পড়ালেখা ছাড়া বাঁচার কোনো পরিপূর্ণ স্বাদ-ঘ্রাণ আমার নেই। অসুস্থতায় এই কষ্ট বড় বেশি পোড়াচ্ছে। আমি পড়তে চাই- লিখতে চাই, অন্তত যে কদিন বাঁচি’। এরকম ১১ এপ্রিল পর্যন্ত লিখলেন তাঁর টাইমলাইনে। এমন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ কামাল পাশা ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের জন্য বড় বেদনার, বড় কষ্টের।
২.
মোস্তফা কামাল পাশা ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলাম লেখক। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করেছেন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয়কর্মী ছিলেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৮২ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আঁকড়ে ছিলেন এ-পেশাকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একনিষ্ঠ সৈনিক মোস্তফা কামাল পাশা পুরো জীবনজুড়ে চর্চা করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক মনোভাবকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন কর্মজীবনে।
ব্যক্তিগত জীবনে মোস্তফা কামাল পাশা ছিলেন অস্থির প্রকৃতির। তবে ছিলেন স্পষ্টবাদী, সাহসী, নির্ভীক, অকুণ্ঠ মেধার অধিকারী ও শির উঁচু করে চলা এক মানুষ। মনের কথাগুলো অকপটে বলতেন, কোনো রাখঢাক থাকতো না। অপ্রিয় সত্য উচ্চারণে ছিলেন নির্মোহ। পরোয়া করতেন না তার পরিণামের। ক্ষমতালোভী, তেলবাজ, ধান্ধাবাজ, সুবিধাবাদী চরিত্রের মানুষগুলোর পোস্টমর্টেম লক্ষ করতাম তাঁর লেখাগুলোতে। বৈঠকী আড্ডাতেও থাকতেন উচ্চকণ্ঠ। মুখের ওপর বলে ফেলতেন বুকের সকল কথা, তুলে ধরতেন কদর্য দিকগুলো। তাঁর কথাগুলো অনেককে আহত করতো। ফলে বলা যাবে না যে তিনি অনেকের প্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাঁর লেখাগুলো ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। তিনি যা লিখতেন, তাতে কৃত্রিমতা থাকতো না। এক ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল লেখায়। কোনোরকম প্রস্তুতি না নিয়েই যে ভালো লেখা উপহার দেওয়া যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ মোস্তফা কামাল পাশা। তাঁর লেখাগুলো তরতর করে এগিয়ে যেতো। বাক্য গঠনে, ভাষা প্রয়োগে, ভাব প্রকাশে সর্বোপরি লেখা নির্মাণে কোনো জটিলতা থাকতো না। ব্যঙ্গ, শ্লেষ, খোঁচা- এসব বিষয় লেখার সঙ্গে লেপ্টে থাকতো। আজাদীতে প্রকাশিত তাঁর প্রায় সব লেখাই পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। আমি নানা সময়ে তাঁকে বিষয় দিতাম লেখার জন্য। যে কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ ও কলাম রচনায় তাঁর দক্ষতা অতুলনীয়।
কলাম ছাড়াও সাহিত্যের নানা শাখায় তিনি কাজ করেছেন। বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি কলম ধরেছেন ছোটোদের জন্যও। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। এর মধ্যে রয়েছে বড়দের গল্পগ্রন্থ ‘ঠিকানা লাশকাটা ঘর’ ও ছোটোদের গল্পগ্রন্থ ‘ভয় নেই আমরা আছি’; উপন্যাস : ‘নীল বিষের ছোঁয়া’, ‘চন্দ্রিমা’ ‘উড়ুক্কু পোকামাকড়’ এবং পাঁচমিশালী গ্রন্থ : ‘আল্লাহর ঘরে আগন্তুক’। ভাবতে ভালো লাগছে যে তাঁর গল্পগ্রন্থ দুটি আমি প্রকাশ করে দিয়েছিলাম।
‘আল্লাহর ঘরে আগন্তুক’ তাঁর প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ। ১৬০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে ১২ টি গল্প, ৮ টি কবিতা ও ছড়া, ১৩ টি স্মরণ ও ১৮ টি কলাম রয়েছে। স্মরণ পর্বে অন্তর্ভুক্ত হলেন- জহুর আহমদ চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, এম এ মান্নান, মহিউদ্দিন চৌধুরী, এম এ ওহাব, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আবদুল্লাহ আল ছগীর, নুরুল আলম চৌধুরী, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন, রফিকুল আনোয়ার, জাহানারা বেগম, কাজী ইনামুল হক দানু ও সাইফুদ্দিন খালেদ।
গাঙচিল নামে ছোটদের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। চালু করেছিলেন গাঙচিল শিশুসাহিত্য পুরস্কার। তবে নিজে স্বীকৃতি, পদক, পুরস্কারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তবে আমি জানি তাঁর রয়েছে ব্যাপক ভক্ত-পাঠক। তিনি পেয়েছেন সেই পাঠকদের ভালোবাসা।
৩.
মোস্তফা কামাল পাশা ছিলেন আজাদী-অন্তপ্রাণ মানুষ। আজাদীর সুনামকে তাঁর নিজের সুনাম মনে করতেন। আজাদীর বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক একুশে পদকে ভূষিত হওয়ার পর ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে কামাল পাশা ভাই একটা পোস্ট দেন তাঁর ফেসবুকে। শিরোনাম : ‘আজাদী মানেই রেকর্ডের ঝড়’। লেখার সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন তিনটি ছবি। আমাদের দুই শ্রদ্ধেয় সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও এম এ মালেকের সঙ্গে আমার ছবিও সংযুক্ত করে আমার প্রতি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। তাঁর লেখাটি এখানে তুলে ধরলাম :
“টানা ৬২ বছর পাঠকপ্রিয়তা ধরে রাখা দেশের একমাত্র দৈনিক আজাদী। স্বাধীনতার প্রথম দৈনিকও আজাদী। আঞ্চলিক দৈনিক হলেও জাতীয় পর্যায়ে অন্যতম প্রভাবশালী মিডিয়া আজাদী। শতভাগ নিখুঁত বলা যাবে না। আছে নানা সীমাবদ্ধতা, প্রাতিষ্ঠানিক মনোযোগে কিছুটা অবহেলাও। তবুও আজাদীর ঝুলিতে জমা হয়, সব রেকর্ড। বিরল রেকর্ডতো বটেই। সব জাতীয় পদক একের পর এক আজাদীর ব্যাকপ্যাকে।
প্রথমে শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পদক ওঠে আজাদীর রাশেদ রউফ এর ভাঁড়ারে। এরপর সর্বোচ্চ বেসরকারি জাতীয় পদক স্বাধীনতা পদক (সাংবাদিকতায় মরণোত্তর) উঠে সফল আজাদী সম্পাদক মরহুম অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এর জমার ঘরে। তাঁর জীবৎকালে এটা পেলে পরিপূর্ণ সম্মান দেখানো হত। হয়নি, অবশ্য ‘শেষ ভাল যার সব ভালও তার’! প্রবচনটিই সই। এখন ষোলকলার একটা রত্নই বাকী কেবল। আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। এই মহামতি জ্ঞানতাপস জাতির কঠিন দুঃসময়ে মেধা-মননের খরাদগ্ধ অনুর্বর জমিতে কঠিন চাষ দিয়ে আজাদীকে পুষ্ট করেছেন। তিনি সেরা জাতীয় পদকে অভিষিক্ত হলে চট্টগ্রামের মানুষ নিশ্চিত সবচেয়ে বেশি খুশি হবেই।
এবার উঠছে দ্বিতীয় সেরা জাতীয় পুরস্কার একুশে পদক (সাংবাদিকতায়) আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক-এর গলায়। এঁদের কারো মেধা, মনন, অবদান, গুণ, যোগ্যতা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করছি না। কারণ গুণের সাথে সাথে মানুষের মানবিক ত্রুটিও থাকে। আমরা সফলদের শুধু গুণ আর কীর্তির ইট সাজিয়ে কৃত্রিম রঙিন ঝর্ণা বানাই। এটা প্রচলিত রেওয়াজ। কৃত্রিম ঝর্ণা খুবই ক্ষীণজীবী, ইটও শ্যাওলাধরা। কৃতী মানুষটার মূল্যায়নের বদলে অবমূল্যায়ন হয় বেশি। তাই ও-পথে সহজে হাঁটছি না। উনারা তিনজনই আমার প্রিয়জন এবং সম্মানিত। রাশেদ রউফ অনুজ সহকর্মীও। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এবং এম এ মালেক সম্পাদক। উনাদের খুব কাছে থেকেও কিছুটা দূরেই ছিলাম, আছি। আখেরে লাভটা আমারই। অকারণ পিঠ চাপড়ানি না থাকায় আড়ষ্টতা থাকে। আড়ষ্টতা নিজের সেরাটা বের করে আনতে সাহায্য করে বেশ।
আজাদীই আমার সাংবাদিকতার আসল পাঠশালা। তাই অবশেসন, আবেগ বা মোহ থাকবেই। ১৬ বছর টানা বাস্তব শিক্ষা নিয়ে গত শতকের ৯৭ সালের মাঝামাঝি স্বেচ্ছায় আজাদী থেকে ছুটি নেই। চাকরির জোঁয়াল কাঁধে তুলিনি আর। কিন্তু আজাদীর বাস্তব শিক্ষা আমার শব্দচাষ সম্ভবত আরো শাণিত ও জোরালো করেছে। ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর আরো কিছু প্রান্তে। যা, আমৃত্যু থামবে বলে মনে হয় না। তাই আজাদীর ‘ট্রিপল ক্রেডিটে’ অন্যদের চ্থে আমি একটু বেশি খুশি। অভিনন্দন সফল সম্পাদক এম এ মালেক। বিশ্বাস, প্রণোদনাটা আপনার হিউমার চাষ চালু রাখতে নিশ্চিত অনুপ্রেরণা যোগাবে”।
এই পোস্ট দেওয়ার পর ভাইরাল হয়ে যায় তাঁর লেখাটি। অনেকে পোস্টার করে পোস্ট দিয়েছেন এভাবে : “স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার, বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক পেয়েছেন একুশে পদক এবং সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। একটি পত্রিকার জন্য এটি শ্লাঘার বিষয়। এটি আজাদীর বিরল অর্জন। এই অতুলনীয় অর্জনে আমরা আজাদীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
পোস্টারটি শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়, যখন শহরের বিভিন্ন স্থানে দেয়ালে স্থান পায়, তখন শ্রদ্ধায় মাথা নত করি কামাল পাশা ভাইয়ের প্রতি। তিনি আজাদী, আজাদীর শ্রদ্ধেয় সম্পাদকদের এবং আমার প্রতি যেভাবে তাঁর ভালোবাসা দেখালেন, তাতে রীতিমত অভিভূত হয়েছি। তাঁর বলার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না, ভণিতা ছিল না। অকপটে বলেছিলেন মনের কথাগুলো।
মোস্তফা কামাল পাশা আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁকে মনে পড়বে আমাদের সাংবাদিকতা জীবনে, নানা কর্মে। ওপারে তিনি ভালো থাকুন।
মোস্তফা কামাল পাশা ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলাম লেখক। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করেছেন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয়কর্মী ছিলেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৮২ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আঁকড়ে ছিলেন এ-পেশাকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একনিষ্ঠ সৈনিক মোস্তফা কামাল পাশা পুরো জীবনজুড়ে চর্চা করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক মনোভাবকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন কর্মজীবনে।