বরেণ্য অভিনেতা ও নির্দেশক আলী যাকের আর নেই। গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। (ইন্নালিল্লাহি….রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৭৬ বছর। বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন আলী যাকের। সেই চিকিৎসার অংশ হিসেবে নিয়মিত থেরাপি চলছিল তাঁর। গত সপ্তাহে শারীরিক সমস্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে সিসিইউতে নেওয়া হয়। পরে কিছুটা সুস্থ হলে শনিবার বাসায় নেওয়া হয়। রোববার আবার ভর্তি করানো হয়। সোমবার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। স্ত্রী অভিনয় শিল্পী সারা যাকের, ছেলে অভিনেতা ইরেশ যাকের, ছেলের বউ মিম রশিদ, নাতনি নেহা ও মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়াকে রেখে যান তিনি। সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি আলী যাকেরের মরদেহ। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার বন্ধু-সুহৃদ-স্বজন এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের শুরুতেই ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক আলী যাকেরকে। এরপর তার মরদেহে একে একে শ্রদ্ধা জানান সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। আওয়ামী লীগের পক্ষে একটি প্রতিনিধি দল আলী যাকেরের মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানীতে তার প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিকের কার্যালয়ে। সেখান থেকে বাদ আসর আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানে জানাজা শেষে চিরনিদ্রায় শায়িত হন দেশের নাট্যাঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
নাট্য ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুননেসা ইন্দিরা প্রমুখ পৃথক বার্তায় শোক প্রকাশ করেছেন।
আলী যাকের ১৯৪৪ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বাবা মোহাম্মদ তাহের ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বাবার চাকরির বদলি সূত্রে অল্প বয়সে কুষ্টিয়া ও মাদারীপুরে কাটান আলী যাকের। আলী যাকের ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ওই বছরেরই জুন মাসে তিনি নাগরিক নাট্য সমপ্রদায়ে যোগ দেন। তখন থেকে নাগরিকই তাঁর ঠিকানা। ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘কোপেনিকের ক্যাপটেন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘ম্যাকবেথ’, নূরলদীনের সারাজীবন’সহ অনেক আলোচিত মঞ্চনাটকের অভিনেতা ও নির্দেশক তিনি। পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেও তিনি পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি’, ‘পাথর’, ‘দেয়াল’সহ বহু নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন আলী যাকের। বেতারে ৫০টির বেশি নাটক করেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্রে। ‘লালসালু’, ‘আগামী’, ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘রাবেয়া’ তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লেখাসহ নানা বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করেছেন দীর্ঘদিন। তিনি একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে সংস্কৃতি ও নাট্য অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।