এক অভূতপূর্ব অর্জন। বিজয়ের মাসে আরেক বিজয়। তিন বছর দুই মাস দশ দিনের মাথায় এলো সেই স্বপ্নের দিন। বৃহস্পতিবার সেতুতে শেষ স্প্যান বসানোর পর প্রমত্ত পদ্মার দুই পাড়ে রচিত হলো প্রত্যাশিত সেতুবন্ধন। সংবাদমাধ্যমগুলোতে নানা রকম আবেগ ও স্বপ্ন ছোঁয়ার আন্তরিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সবাই আপ্লুত। তাঁরা বলছেন, যেন এক নতুন সূর্যোদয় হলো সোনারোদ ছড়িয়ে। কেটে গেল কুয়াশার ঘোর। দিগন্তে ছড়িয়ে গেল স্বপ্নপূরণের আনন্দরেণু। এক মহাকর্মযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে অবশেষে মাথা তুলে দাঁড়াল স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যুক্ত হলো প্রমত্ত পদ্মার এপার-ওপার। তাঁরা আরো বলছেন, বাংলাদেশের স্বপ্ন সফলতার প্রতীক হয়ে উঠল পদ্মা সেতু। ৪২টি পিলারে ৪১টি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে এখন পূর্ণাঙ্গ দৃশ্যমান। ১৬ কোটি মানুষের আবেগের পদ্মা সেতু স্বপ্ন হয়ে শুরু থেকেই বাস্তবের দিকে এগিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার কুয়াশাচ্ছন্ন দুপুরে বসেছে সবশেষ স্প্যান; মিলেছে পদ্মার দুই পাড়।
সরকার আশা করছে, ২০২১ সালের বিজয় দিবসের আগেই তা শেষ হবে। এরপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সারাদেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ২০২২ সালের জুনের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেওয়া সম্ভব হবে। এরই মধ্যে ভায়াডাক্ট, অর্থাৎ মূল নদীর বাইরে পিলার ও স্প্যান বসানো, সংযোগ সড়ক, নদীশাসনের কাজ শেষ হয়েছে।
২০২২ সালের জুন আর বেশি দূরে নয়। তারপরই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে সেতু। স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে, স্বপ্ন ছুঁয়ে যাবে মুহুর্মুহু। সব বিতর্ক পেছনে ফেলে দৃশ্যমান হয়েছে বিশ্বের ১২২তম এবং বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই সেতু। এখন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার তিন কোটি মানুষ সরাসরি যুক্ত হবে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে। অথচ ভাঙন আর নৌকাডুবির মতো অজস্র ঘটনায় স্বজনহারাদের চোখের জলে ভিজেছে পদ্মার দুপাড়।
পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। তবে স্বপ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে ২০০৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর থেকেই। মাঝখানে দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত জটিলতায় বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে টানাপোড়েনে কিছুটা সংশয়ের মেঘ দেখা দেয়। তখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগ হয় ভিন্ন এক মাত্রা, সামনে আসে জাতীয় সক্ষমতার প্রশ্ন। প্রথমবারের মতো বিপুল ব্যয়ে এবং কারিগরিভাবে জটিল এই প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগের মাধ্যমে সেই সক্ষমতার যাত্রা শুরু হয়। বিশ্লেষকরা বলেন, কোটি মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সঙ্গে যোগ হয় সহস্র কর্মীর হাত, শত প্রকৌশলীর মেধা। একেকটা পিলার (খুঁটি) বসানো, স্প্যান জোড়া দেওয়ার ঘটনা-সবকিছুতেই গর্ব খুঁজতে থাকে বাংলাদেশের মানুষ। বৃহস্পতিবার ইস্পাতের সর্বশেষ স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে সক্ষমতার চূড়ান্ত রূপ দেখল দেশবাসী।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান এম শামীম জেড বসুনিয়া তাঁর এক লেখায় বলেছেন, পদ্মা সেতু করতে গিয়ে মানের বেলায় কোনো ধরনের আপস করা হয়নি। সবকিছুই ছিল স্বচ্ছ। মোট প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে শুধু সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু বানাতে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। নদীশাসনে যাচ্ছে আট হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা খরচ হয়েছে মাওয়া অংশে অ্যাপ্রোচ সড়ক, জাজিরা অংশে অ্যাপ্রোচ সড়ক এবং বিভিন্ন পরিষেবা নির্মাণে। সব হিসাব স্বচ্ছ। তাই এককথায় বলা যায়, পদ্মা সেতুতে কোনো বিচ্যুতি হয়নি।
স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে দেশের মানুষকে অভাবনীয় উপহার দেওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাঁকেই আমরা সকল জনগণের পক্ষে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদাবোধই এমন একটি দুরূহ ব্যয়বহুল নির্মাণের স্বপ্নকে সফল করে তুলেছে। আমরা জানি, শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তিনি এগিয়ে গেছেন। এই সেতু নিয়ে দেশে ও বিদেশে কম চক্রান্ত হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যার অবিচল দৃঢ়তায় স্বপ্ন সার্থক হলো, পূরণ হলো দেশবাসীর প্রত্যাশা। সফল হলো প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছে।