একাকিত্ব: পারিবারিক ও সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা

নাজমুল হক, গবেষক | রবিবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আব্দুর রশিদ দীর্ঘদিন একাকিত্ব ভোগ করে ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে রাজধানী ঢাকায় ট্টেনে কাটা পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলে মেয়ের শিক্ষা ও ভরণ পোষণ এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত স্ত্রীর খোরপোষ বহন করে রাজধানীতে একাকিত্ব নিয়ে বসবাস করেন। স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে উন্নত রাষ্ট্রর নাগরিক। আধুনিক ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী শিক্ষক ট্রেনে কাটা পড়ে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি ছেলে মেয়ে থেকে পিতা মাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৪ অনুযায়ী অধিকার আদায় থেকেও দায়মুক্তি পেয়েছেন।

দুই বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান একাকিত্ব নিয়ে বসবাস করে উত্তরার ১৮ নং সেক্টরের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তার বাসার গৃহ পরিচারিকা ২ দিন পরে এসে ডাকাডাকি করে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করে! পুলিশ এসে ঘর থেকে শিক্ষকের লাশ উদ্ধার করে। তার স্ত্রী ছেলে মেয়ে উন্নত রাষ্ট্র আমেরিকার নাগরিক।

উচ্চ শিক্ষিত এই গুণীজনদের প্রতি স্ত্রী ছেলে মেয়ে আত্মীয় স্বজন বন্ধু প্রতিবেশী, নীল দল ও সাদা দল শিক্ষক প্রতিনিধি সুশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের কি কোনো দায়বদ্বতা আছে কি। এ দেশে টাকার পিছনে ছুটছে যারা এবং ছেলে মেয়েকে উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিক তৈরি করছে যারা তাদের জন্য শিক্ষণীয় কী? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছেলে মেয়ে থেকে পিতা মাতার অধিকার আদায়ের জন্য ব্যবস্থা পাঠ্যক্রমে আছে কি?

২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১৪,৪৩৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আধুনিক নারীরা প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী পুরুষের তুলনায় অনেক অনেক গুণ এগিয়ে রয়েছেন। আত্মহত্যায় নারী ৮২২৮ জন এবং পুরুষ ৬২০৮ জন। নারী ও পুরুষের আত্মহত্যার মূল কারণ স্বামীস্ত্রীর বিরোধ, পারিবারিক কলহ, ব্যবসায় ক্ষতি, শেয়ার বাজারের ধস, চাকরির হতাশা, যুবকের প্রেমে ব্যর্থতা, ছাত্রদের লেখাপড়ার হতাশা, বউকে শাশুড়ীর ও ননদের নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতন, আথিক সংকট, সামাজিক ও পারিবারিক দ্বায়বদ্ধতার অভাব, আত্বীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্কের অভাব, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির জীবন জীবিকার উন্নয়নের জন্য কাউন্সিল এর অভাব । কোভিড মহামারী পরিস্থিতি মোকাবিলায় আথিক সংকট, ব্যবসায় ক্ষতি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হারানো, শেয়ার বাজারের ধসের ক্ষতি, রাজনৈতিক নিযাতন ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে আত্মহত্যা বেড়েছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায়।

প্রথম আলোর ১৩ মার্চ ২০২১ এর রিপোর্ট দেখা যায় বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ১০ হাজারের অধিক মানুষ আত্মহত্যা করেছে। ২০২০ সালে ১৪,৪৩৬ জন। ২০১৯ সালের তুলনায় ৪৪.৩৬% বেড়েছে। প্রগতিশীল নারীদের আত্মহত্যা ৫৭% এবং পুরুষের আত্মহত্যা ৪৩%। বাংলাদেশের বছর ভিত্তিক আত্মহত্যার চিত্র: ১৯ বছরের আত্মহত্যা ৩৬%, ২০৩৫ বছরের ৪৯%, ৩৬৪৫ বছরের ১১% এবং ৪৬৮০ বছরের ৫%

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ লক্ষ মানুষের কত % আত্মহত্যা করে () গায়না ৪২.% () দক্ষিণ কোরিয়া ২৮.% () শ্রীলঙ্কা ২৮.% () লিথুনিয়া ২৮.% () সুরিয়াম ২৭.% () মোজাম্বিক ২৭.% () নেপাল ২৪.% () কাজাকিস্তান ২৩.% () বুরুন্ডি ২৩.%

বাংলাদেশে পারিবারিক সমস্যায় ৩৫%, অথনৈতিক সমস্যায় ২৪%, লেখাপড়ার জন্য ৪.%, অন্যান্য কারণে ৩২% আত্মহত্যা করে।

ইসলামের ধর্মীয় বিধান অনুসারে আত্মহত্যাকারীর স্থান জাহান্নামে। জীবন দিয়ে থাকে আল্লাহ তায়ালা এবং জীবন শেষ করার দায়িত্ব আল্লাহর। কালিমা পড়ে এবং দোয়া দরুদ পড়ে আল্লাহর নামে আত্মহত্যা করার কোনো জাস্টিফিকেশন নেই।

ফেসবুকে কোনো একজন লিখেছেন ‘প্রত্যেকটা মানুষের একটা কথা মনে রাখা উচিত পৃথিবীটা একটা স্বার্থের জায়গা। দিনশেষে সবাই স্বার্থের কথা চিন্তা করে। এখানে আপনি ততোক্ষণ পর্যন্তই কারো জীবনে আপন হয়ে থাকবেন যতোক্ষণ পর্যন্ত আপনার দ্বারা তার স্বার্থ হাসিল হবে। আপনার দ্বারা তার জীবনে কোনো উপকার হবে। স্বার্থ শেষ, উপকারও শেষ! দেখবেন আপনার এক পয়সাও মূল্য নেই। আপনি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া ময়লার মতো অপ্রোয়জনীয়। আসলে পৃথিবীতে বাঁচতে হলে অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়াটা ছেড়ে দিতে হবে। নিজেকে এমন ভাবে গড়তে তুলতে হবেযেনো সবাই ছেড়ে চলে গেলেও নিজেকে নিজে সামলে উঠা যায়। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আমাদের হাজার বছরের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি ধরে রাখতে না পারলে পশ্চিমা বিশ্বের ন্যায় এদেশেও আত্মহত্যার পরিমাণ কয়েক লক্ষ গুণ বেড়ে যাবে’!

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণ ব্যক্তির জীবন নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। ছেলে মেয়েকে উন্নত রাষ্ট্রে স্বাবলম্বী করতে গিয়ে একটা অমানুষ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। শিক্ষিত ও ধনীক শ্রেণির নাগরিক শেষ জীবন নিয়ে হতাশ ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। প্রবীণদের পারিবারিক জীবন যাপন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ মানুষের জীবনে সুখ ও শান্তি নেই, দুঃখ প্রতিটি পরিবারে বাসা বেঁধেছে। টাকা আছে সন্তান আছে কিন্তু নিরাপদ মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। স্ত্রী ছেলে মেয়ে কেউই চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী প্রবীণ পিতার দায়িত্ব গ্রহণ করছে না। শিক্ষা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য পিতার টাকাকড়ি গ্রহণ করবে, জমি বাড়ি গাড়ি ভোগ করবে কিন্তু পিতাকে সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকার দিবে না, খাদ্যের ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে না। স্ত্রীর কাছে স্বামী ভালো লাগে, স্বামীর টাকা ফ্ল্যাট বাড়ি গাড়ি ভালো লাগে কিন্তু স্বামীর পিতা মাতাকে ভালো লাগে না। স্বামীর ভাই বোন আত্বীয় স্বজন ভালো লাগে না, স্ত্রী তার ভাই বোন আত্মীয় স্বজনকে দেখতে পারে। আমরা আছি এক অসভ্য সমাজে, যেখানে স্বামী স্ত্রী একসাথে বসবাস করতে চায় না। নারীর অধিকার ও স্বামীর অধিকার, পিতার অধিকার আদায়ের সুযোগ নেই। এই সমাজ ও সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মকে ল বদলাতে হবে।

আমাদের দেশের মানুষকে সচেতন ও সাহসি করতে হবে পিতা মাতা ভাই বোন আত্বীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে পারিবারিক বন্ধন ও মজবুত করতে হবে। ছেলে মেয়েকে পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সংস্কৃতি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে পারিবারিক জীবন দিয়ে গড়তে হবে। ইউরোপ আমেরিকার নাগরিকদের জীবন যাপন সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একটি মূল্যবান ঘটনা শেয়ার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

প্রফেসর তোহর আহমেদ হেলালি লিখেছেন – ‘আপনার জন্য স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি একটি পরীক্ষা। আপনাকে তাদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল করা হয়েছে। দায়িত্বের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন আপনাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।

আপনার উপার্জন হালাল না হলে তারা কেউ দায় গ্রহণ করবে না, যদিও আপনি তাদেরকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যেই অবৈধ উপার্জনের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। বিপদের দিন সবাই আপনার থেকে পালাবে এবং বলবে, আমরা কখনই হারাম পথে চলার জন্য বলিনি।

জান্নাতে স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানসন্ততিসহ একত্রে বসবাস করতে হলে সৎ কাজে সবাইকে পরস্পর সহযোগী হতে হবে। আসুন, আমরা দুআ করি, আল্লাহপাক যেন আমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানসন্ততিকে চোখ শীতলকারী বানিয়ে দেন।

হতাশা থেকে আত্মহত্যা জীবন সমাপ্ত করে না। আত্মহত্যা জীবনকে ধ্বংসের গভীরে নিয়ে যায়। জান্নাত হারাম হয়ে যায়। টাকার পিছনে ধনীদের ছোটাছুটি নতুন প্রজন্ম অমানুষ জাতি হিসেবে গড়ে উঠছে। নতুন প্রজন্ম ভোগবাদী জীবনের দিকে ধাবিত করছে। মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে। আসুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পিতা মাতার অধিকার, প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনের অধিকার আদায়ের জন্য এগিয়ে আসার প্রশিক্ষণ প্রদান করি। ছেলে মেয়েকে দাদা দাদি, চাচা চাচি, ফুফা ফুফু, খালা খালু, নানা নানি, মামা মামি, প্রতিবেশীদের সাথে মিশার সুযোগ করে দিই। একটা ঈদ মহানগর ও জেলা শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে করি। বছরে অন্তত ২ বার পরিবার নিয়ে গ্রামে যাই এবং আত্মীয়দের খোঁজ খবর রাখি। নিজ বাসায় দাওয়াত দেওয়া, আসা যাওয়া অব্যাহত রাখি। পারিবারিক ও আত্মীয়দের নিয়ে পিকনিক করি। নিজ নিজ ধর্মীয় বিধান পালন করি। প্রবীণদের সাহায্য করি। কাউন্সিলিং করি। লেখক: গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী নেতৃত্ব
পরবর্তী নিবন্ধঅপার সম্ভাবনাময় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ