দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের প্রতিটি দেশে বিভিন্ন দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশে যে সব দিবস জাতীয়ভাবে পালিত হয় তা হচ্ছে বাংলা নববর্ষ, মাতৃভাষা দিবস, ২৬ শে মার্চ, স্বাধীনতা দিবস, ১লা মে (শ্রম অধিকার দিবস), ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এসব দিবসগুলো পালন শুধু অনুপ্রাণিকতা নয়। এসবের উদ্দেশ্য হলো বর্তমান প্রজন্মকে জানান দেয়া, কিভাবে দিবসটি আমরা পেলাম ইত্যাদি। কিছু কিছু দিবস আছে আমরা উদযাপন করি আবার কিছু আছে পালন করি। উৎসাহ উদ্দীপনায় যে সব দিবস পালন করা বা উদযাপন করা হয়। তা হচ্ছে উৎসবের আবার যেগুলো পালন করা হয় তা হচ্ছে আমাদের অধিকার আদায়ের দিবস।
আজ ১৫ অক্টোবর বিশ্ব সাদাছড়ি দিবস। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিরাপদ চলাচলের প্রতীক ‘সাদা ছড়ি নিরাপত্তা দিবস’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব সাদা ছড়ি দিবস। সাদাছড়ি মানুষদের সাধারণ মানুষের দায়িত্বের বিষয়গুলো মনে করিয়ে দেওয়ায় এই দিবসের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ হয় প্রতিবন্ধী। সেই হিসেবে সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৭০ লক্ষ। এরমধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। এরইমধ্যে প্রধান হচ্ছে অন্ধ, বিকলাঙ্গ, বোবা, বধির, অটিস্টিক অন্যতম। এই প্রতিবন্ধীর কারণ শুধু যে জন্মগত তা নয়। জন্মের পূর্বে মাতৃগর্ভের থাকাকালীন মা’র সঠিক পরিচর্যার অভাবও অন্যতম।
সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো হলেও এখন গ্রামের একটি বিরাট অংশ ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। ধাই দিয়ে বাচ্চা প্রসব করানোর প্রবণতা এখনো কম নয়। এছাড়াও বাস, ট্রাক, ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ প্রতিবন্ধীতার শিকার হচ্ছে। সড়কে দুর্ঘটনায় কমানোর জন্য সড়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়া দরকার। দুর্ঘটনায় যেসব মানুষ প্রতিবন্ধী তারা শুধু পরিবারের জন্য বোঝাই হচ্ছে না বরং তাদের যে কাজ কর্ম ছিল তা দিয়ে দেশের নানা ক্ষেত্রে যে অবদান রাখতে পারতো তা থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলোর ন্যায় বাংলাদেশ সরকার এসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি তাদের জন্য শিক্ষা ও প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
রাস্তা ঘাটে বের হলেই আমরা দেখি কিছু সংখ্যক পুরুষ বা মহিলা সাদাছড়ি হাতে রাস্তায় চলাচল করে। তারা সাদাছড়ি হাতে চলতে চলতে একটি দক্ষতা অর্জন করে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে রাস্তায় হাঁটাচলা করে। তবে কোনও কোনও স্থানে তাদের অসুবিধা হলে তাদের সাহায্যে মানুষ এগিয়ে আসতে দেখা যায়। বর্তমানে সমাজ সচেতনতার কারণে আমরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদাছড়ি হাতে ছেলে–মেয়েদের পদচারণা দেখতে পাই। এতে সমাজ পরিবর্তনের ভূমিকা রয়েছে।
দীর্ঘদিন আগে থেকে ব্রেইল পদ্ধতির মাধ্যমে অন্ধ ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া চালিয়ে আসছে। এখন তারা কম্পিউটার চালনা, মোবাইল ব্যবহারেও সক্ষম। এসব সম্ভব হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে। সরকারের সাহায্য সহযোগিতার পাশাপাশি বর্তমানে বাংলাদেশে হাজার হাজার বেসরকারি সংস্থা ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়নে সাহায্য করছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলো তাদের কোটাভিত্তিকভাবে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে জনগণের সগযোগিতা তাদের আরও এগিয়ে নিতে যাবে।
১৫ অক্টোবর আর্ন্তজাতিক সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবসের পালন উদ্দেশ্য হলো (১) দৃষ্টি প্রতিন্ধীসহ আমাদের জীবনে এই দিবসের গুরুত্ব উপলব্ধি করা। (২) দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মেধা, কৌশল, প্রতিভা ইত্যাদিকে মূল্যায়ন করতে তাদের সফল জীবন কাহিনি জনসম্মুখে তুলে ধরা। (৩) দিবসটির তাৎপর্য জাতীয় জীবনে অর্থাৎ জনগণের কাছে তুলে ধরতে গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। (৪) দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ত করণের মাধ্যমে এবং তাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কৃত করা।
এই দিবসটি পালনে অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই যে, (ক) যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৬ই অক্টোবর ১৯৬৪ সালে ঘোষণা করেন যে সে বছর ১৫ অক্টোবর সারাদেশে জাতীয়ভাবে সাদা ছড়ি নিরাপত্তা দিবস পালন করা হবে এবং এ পর্যন্ত এ দেশসহ সারবিশ্বে দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়। ২০১১ সালে এই দিবসকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকার অন্ধ আমেরিকান সমতা দিবস হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল।
(খ) ১৯২১ সালে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরের মি. জেমস নামের এক ফটোগ্রাফার দূুর্ঘটনায় তার দৃষ্টিশক্তি হারালে তার পথ চলার জন্য লাঠি সাদা রঙে রঞ্জিত করেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে অপরের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
(গ) ১৯৩০ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ানস পিওরিয়া নামক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট জর্জ বেনহাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের লাঠিতে লাল রঙের ব্যান্ড জড়িত করে অপরাপর দৃষ্টিমান ব্যক্তিদের সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে সূচনা করেন।
(ঘ) এরপর গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিশ্বজুড়ে লায়ন্স ক্লাবের মাধ্যমে চক্ষুদান এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একে অপরকে সহযোগিতার হাতিয়ার হিসেবে সাদাছড়ি বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেন।
(ঙ) ১৯৩১ সালে ফ্রান্সের মি. গুইলি. ডি. হার বিশ্বের সারাদেশে ‘জাতীয় সাদাছড়ি মুভমেন্ট’ হিসেবে ১৫ অক্টোবরকে ঘোষণা করেন এবং প্রচলন করেন– সে বছর প্যারিসে ৫০০০ সাদাছড়ি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করেন।
(চ) শ্রীলঙ্কায় এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ৯০ দশক থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে।
(ছ) বাংলাদেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ৭০ দশক থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে।
উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বের অন্ধ ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ২৮ কোটি। এ দিবস সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দিবসটি নিয়ে সভা, সেমিনার, প্রবন্ধ লেখা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়া বিভিন্ন অসুখ বিসুখের মাধ্যমে সৃষ্ট অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পেতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দরকার। সর্বোপরি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে এবং তাদের জন্য সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
লেখক: প্রবীণ সাংবাদিক