একটি সুবর্ণ কার্ড ও প্রতিবন্ধীদের বিড়ম্বনা

আয়েশা পারভিন চৌধুরী | শনিবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২৩ at ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস পালন করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে একটি পরিবারের দুঃখ কষ্ট বেদনা যন্ত্রণা। যে পরিবারে একটি প্রতিবন্ধী সন্তান আছে সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্য মানসিক ও শারীরিকভাবে সেই প্রতিবন্ধী জীবনের দুঃখ কষ্ট বেদনা বয়ে বেড়ায়। যতদিন সেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিটা বেঁচে থাকে ততদিন আশেপাশে থাকা মানুষগুলো ও পরিবার পরিজনের সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়তো পরিবারের অনেকের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। মনোমালিন্যের ফলে ও দায়িত্ব নিয়ে ভাগাভাগির কারণে সবার মাঝে এক ধরনের বিভেদের সৃষ্টি হয়। তবুও দিন শেষে আপনজনরাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিটিকে সকল কিছু থেকে আগলে রাখে। বিশেষ করে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী তারা তাদের নিজস্ব চেষ্টার মাধ্যমে ব্যক্তিগত কাজগুলো করতে পারে। তাছাড়া তারা সকল ধরনের চাহিদাও প্রকাশ করতে পারে। ভালোমন্দ জানাতে পারে। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তার দাবি দাওয়াগুলো তুলে ধরতে পারে। অনেকে আবার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া চালিয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধীরা কাজ করছেন। তাদের উপার্জিত আয়ে অনেক সংসার চলে যাচ্ছে। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অনেকে আবার বিয়ে শাদী করে সংসার জীবন শুরু করেন। তাদের সন্তানরা সেই প্রতিবন্ধী বাবা ও মায়ের উপার্জিত আয়ে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে উল্লেখ্য; একজন প্রতিবন্ধী যখন প্রতিবন্ধী কার্ড বানাতে যায় তখন অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হয়। সুবর্ণ কার্ড নামে পরিচিত এই কার্ডটি যদি এলাকা ভিত্তিতে ওয়ার্ড অফিসে হস্তান্তর করা হয় তাহলে প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক সুবিধা হতো। পরিচিত পরিবেশে পরিচিত মানুষের সহায়তায় তারা প্রতিবন্ধী কার্ড বানাতে পারতো। আর সেই পরিচিত মানুষগুলো তাদের এলাকার প্রতিবন্ধী মানুষের সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে পারতো।

আমাদের সমাজে তাদেরকে সাধারণত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলা হয়। একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তান একটি পরিবারের সারা জীবনের বোঝা হয়ে থাকে। কারণ তারা তাদের ভালোমন্দ চাওয়া পাওয়া কোনও কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। তাদের যে নিজস্ব একটি ব্যক্তিগত জীবন আছে সে বিষয়টাও তারা অনুধাবন করতে পারে না। প্রতিটি বিষয়ে তাকে অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানরা অভিভাবকের জন্য এক ধরনের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তানকে যেমন অন্যের উপর দায়িত্ব দিয়ে কিছুটা সময় নিশ্চিত থাকা যায়। কিন্তু একজন মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিকটবর্তী সদস্য ছাড়া কেউ সামলাতে পারে না। বিশেষ করে মায়ের অবর্তমানে বাবা ও ভাই বোনদেরকে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। যে পরিবারের মাবাবা দুজনই চাকরিজীবী সেই পরিবারের অবস্থা অনেক অনেক বেশি শোচনীয় হয়ে যায়। বর্তমান সময়ে চাকুরির ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানে সবাইকে অবস্থান করতে হয়। একটি মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানের অভিভাবকের কঠিন বাস্তবতা বুঝার যে মানসিকতা লাগে অনেক প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের অনেকের সেই ইতিবাচক মানসিকতা নেই। সবার সাথে একসাথে এক নিয়মে প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করে যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়। সমাজের অনেকে মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানের অবস্থা বুঝতে চায় না। এদের মধ্যে অনেক ভিন্নতা আছে। সাধারণত মানুষের গায়ে জ্বর আসলে যেমন জ্বরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয় ঠিক সেভাবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষের বিভিন্ন মাত্রা থাকে। তাদের মাঝে কেউ কেউ হয়তো কিছুটা যোগাযোগ করতে পারে। তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিছু কিছু বোঝাতে পারে। নিজের ব্যক্তিগত প্রাকৃতিক কাজগুলো সারতে পারে। তাদেরকে সামলাতে তেমন বেগ পেতে হয় না। পরিবারের কেউ একজন পাশে থাকলে তাদেরকে কিছুটা সময় সামলানো যায়। কিন্তু মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানদের মধ্যে আবার কেউ তীব্র মানসিক প্রতিবন্ধী আছে। তীব্র মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানদেরকে নিয়েই প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে আরেক অনেক বেশি মানসিক কষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাতে হয়। আর সেই তীব্র মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানের মা যদি চাকরিজীবী হয় তাহলে সে পরিবারে আরও বেশি কষ্ট। অনেকে জীবিকার তাগিতে চাকরি চালিয়ে যায়। আবার অনেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক অর্জিত জ্ঞান চর্চা চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাকরিটা চালিয়ে যায়। এমন অনেক পরিবার আছে যে পরিবারে মাকে চাকরি না করলেও হয় কিন্তু একজন শিক্ষিত মা শুধুমাত্র নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত রাখার জন্য চাকরি করে থাকেন। বর্তমানে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে একজন মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য সবাই সহানুভূতি ও ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। একসময় লোক লজ্জার ভয়ে অনেকে প্রতিবন্ধী সন্তানদের লুকিয়ে রাখতেন। প্রতিবন্ধী সন্তানের কথা অন্যকে প্রকাশ করতে চাইতেন না। কিন্তু বর্তমানে শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তানদের পাশাপাশি মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানরাও সমাজ এবং রাষ্ট্রে তাদের অবস্থান জানিয়ে যাচ্ছে।

যারা প্রতিবন্ধী তাদের কাছে প্রতিবন্ধী কার্ড হচ্ছে একটি অস্তিত্বের পরিচয়। একটা প্রতিবন্ধী কার্ডের মাধ্যমে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রাষ্ট্রের কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য মাসিক হারে কিছু ভাতা দিয়ে থাকেন। বর্তমানে যারা প্রতিবন্ধী কার্ড সংগ্রহ করেছে তারা প্রতি মাসে ৮৫০ টাকা পেয়ে থাকে। কিন্তু এই ন্যূনতম টাকাটি একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে সেটা ভেবে দেখার ও বিবেচনায় আনার উচিত। যেখানে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোনও কিছুই করতে পারে না সেখানে প্রতি মাসে পাওয়া প্রতিবন্ধী ভাতা তেমনভাবে যোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে না। অথচ আমাদের দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা প্রচার হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে অনেক অনেক টাকা ধুলায় মিশে যাচ্ছে। অথচ ন্যায্য পাওনা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি সরকারকে গড়িমসি করতে দেখা যায়। একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন যুদ্ধ সরকারের দৃষ্টিতে আসে না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে সামলিয়ে চলতে গিয়ে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের পরিবারের মানুষগুলোকে অনেক বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়। যাদের পরিবারের প্রতিবন্ধী সন্তান আছে তাদের অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়। তবে প্রতিবন্ধী কার্ড তার অস্তিত্বের প্রতীক। তার বেঁচে থাকার প্রেরণা।

আমাদের দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে যে প্রতিবন্ধী অফিসগুলো আছে সেই অফিসগুলোর পারিপার্শ্বিক অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে এই অফিসগুলো অলিগলির পুরনো বিল্ডিং এ কোনও মতে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও মতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পুরনো বিল্ডিং এর সিঁড়ি ভেঙে যখন একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অফিসে আসে তখন অফিসের পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। অফিসে চেয়ার আছে তো বসার জায়গা নেই। লাইট আছে তো আলো নেই। ফ্যান আছে তো বাতাস নেই। এই অবস্থায় একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী অফিসে একটি কার্ডের জন্য সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অফিসগুলোতে বারবার ধরনা দিতে হয়। যারা এই অফিসগুলোতে চাকরি করেন তাদের মনমানসিকতা অনেক বেশি উদাসীন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সকাল থেকে জড় হলেও সে অফিসের কর্মকর্তাকর্মচারীদের ঠিক সময় মতো দেখা মেলে না। হয়তো সরকারি অফিস বলে সময় মানা হয় না। যেখানে সকাল দশটায় অফিস খোলা হয় সেখানে কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিজেদের খেয়াল খুশী মতো অফিসে আসেন। এরপর যখন উনারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন তেমন ভালো ব্যবহার করেন না। এক ধরনের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার সুরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের পরিবার পরিজনের সাথে কথা বলেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় যোগাযোগ করতে বলার পরেও সে নির্দিষ্ট সময়ে পাড় করে আরো অনেক বার আসতে হয়। ফোনে যোগাযোগ করার পরেও তেমন কোনও আশার বাণী শোনাতে পারেন না। অথচ একটি প্রতিবন্ধী কার্ডের জন্য একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়ে রাস্তাঘাটে প্রতিটি পদে পদে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। শুধু একটি প্রতিবন্ধী কার্ড তৈরি করার জন্য ৫ থেকে ৬ মাস সময় লাগে। বেশ কয়েকবার অফিসে গিয়ে ধর্ণা দিতে হয়। এই প্রতিবন্ধী কার্ডটি তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ওয়ার্ডেও যোগাযোগের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তবু একটি প্রতিবন্ধী কার্ডের জন্য প্রতিবন্ধী পরিবারের সদস্যদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। যারা এই ধরনের অফিসে চাকরিরত আছেন তাদের ইতিবাচক ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিবন্ধী পরিবারের সদস্যদের কষ্ট অনেকটা লাঘব করে দেয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর সরকারের এই মহান প্রচেষ্টাকে আশার আলো দেখাতে সাহায্য করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মানসিক কষ্ট লাঘবের জন্য ও তাদের জন্য একটি সুন্দর আগামী সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী কার্ডকে সুবর্ণ কার্ড হিসেবে অবহিত করেছেন। এই সুবর্ণ কার্ডের মত বর্ণিল রঙে প্রতিবন্ধীদের জীবন অতিবাহিত হোক। আমার আপনার সকলের সহানুভূতি ও ভালোবাসায় শারীরিক ও মানসিক সকল ধরনের প্রতিবন্ধীদের জীবন সহজ ও সুন্দর করে তুলবে। সুবর্ণ কার্ডই হোক একজন প্রতিবন্ধীর অস্তিত্বের প্রতীক; বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা ও রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার মানদণ্ড।

লেখক : প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল হাজেরা ডিগ্রি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধবারে বারে আসি
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে