২৮ জুন সোশ্যাল বিজনেস ডে বা সামাজিক ব্যবসা দিবস হিসাবে দুনিয়ার সামাজিক ব্যবসায়ীদের সংলাপ ও উদযাপনের একটি বার্ষিক ইভেন্ট। এটি ইউনুস সেন্টার (Muhammad Yunus Foundation) এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এবং সহযোগিতায় থাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারের প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক নেতারা। সোশ্যাল বিজনেস ডে ২৮ জুন বেছে নেওয়ার পেছনে একটি বিশেষ কারণ হলো–এই দিনটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মদিন। এই দিনে বিশ্বজুড়ে হাজারো মানুষ তার কাজ দর্শন ও থ্রি জিরো ভিশন এর প্রতি শ্রদ্ধা ও উৎসাহ প্রকাশ করে। এটি শুধু জন্মদিন নয় বরং একটি আন্দোলনের জম্মদিন–যেখানে মানবতার কল্যাণই মূল লক্ষ্য।
থ্রি জিরো ফর্মূলা বা তিন শূন্য লক্ষ্য হলো ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সোশ্যাল বিজনেজ আন্দোলনের একটি মূল ভিত্তি। এটি বিশ্বজুড়ে একটি টেকসই, ন্যায় ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য স্থির করে। এই তিনটি শূন্য হলো :
১। শূন্য দারিদ্র্য : পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ দারিদ্র্য দূর করা, মানুষ যেন নিজের জন্য আয় করতে পারে, উদ্যোগ নিতে পারে, তাতে সমাজ ও নিজের অবস্থান উন্নত হয়।
২। শূন্য বেকারত্ব : চাকরির জন্য অপেক্ষে না করে মানুষ যেন উদ্যোক্ত হতে পারে। সোশ্যাল বিজনেস এর মাধ্যধে সবাইকে কিছু না কিছু কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া।
৩। শূন্য কার্বন নি:সরণ : পরিবেশ বান্ধব সমাজ গঠন করা, এমন ব্যবসা তৈরি করা যা পরিবেশের ক্ষতি না করে বরং উন্নত পরিবেশ গড়ে তোলে।
শিক্ষাবিদ, কর্মযোগী, সরকারের প্রতিনিধিসহ নানা খাতে সক্রিয় উদ্যোগক্তাদের অংশ গ্রহণে প্রতি বছর ২৮ জুন এই তিন লক্ষ্যকে নিয়েই সোশ্যাল বিজনেস ডে পালিত হয়। এবার ২০২৫–এ দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে– “Social Business is the most efficient path of ensure healthcare of all”. যখানে আলোচনা হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা সবার জন্য আনতে সামাজিক ব্যবসার ভূমিকা, প্রযুক্তি ও নীতি প্রসার সহ অর্ন্তভুক্তিমূলক সমাধান নিয়ে।
শূন্য দারিদ্র্যে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রকল্প যেখানে গরিব মানুষকেও ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। শূন্য বেকারত্বে ছোট ঋণের মাধ্যমে নারীদের হস্তশিল্প বা ক্ষুদ্র ব্যবসা চালু করতে সহায়তা করা হয়। শূন্য কার্বন নিঃসরণে সৌর বিদ্যুৎ চালিত সামাজিক ব্যবসা ও পরিবেশ বান্ধব কৃষিকে উৎসাহিত করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে ইউনূস স্যারের নেতৃত্বে বিশ্বের সামাজিক ব্যবসায়িক নেতারা বক্তব্য রাখেন। মুনাফা নয় বরং সমস্যার সমধান করাই হবে সামাজিক ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য। সমাজের সব শ্রেণিকে অর্ন্তভুক্ত করে কাজ করা হবে। তরুণ প্রজন্মকে সৃজনশীল চিন্তা ও কর্মে উদ্বুদ্ধ করা হবে। এ জন্য গঠিত হয়েছে থ্রি জিরো ক্লাব। ছাত্র–ছাত্রী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে গঠিত এই ক্লাব যারা তিন জিরো লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে। সদস্যরা সোশ্যাল বিজনেস প্রজেক্ট করে ওয়ার্কশপে অংশ নেয়, উদ্ভাবনী চিন্তা প্রচার করে। প্রস্তাবিত এই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন একটি পৃথিবী হবে যেখানে তিন বড় সমস্যার সম্পূর্ণ সমধান হবে।
প্রতি বছর এই দিনে স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, শিক্ষা ইত্যাদির উপর আলাদা আলাদা আলোচনা হয়। এছাড়া গবেষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সামাজিক ব্যবসার শিক্ষাগত উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। যুবকদের নিয়ে ‘জিরো কার্বন, জিরো প্রোভার্টি ও জিরো আনএমপ্লয়ম্যান্ট’ লক্ষ্য নির্ধারণ ও উদ্যোগ গ্রহন নিয়ে সভা সমূহ অনুষ্ঠিত হয় থ্রি জিরো ক্লাব কনভেনশনের মাধ্যমে। সামাজিক ব্যবসার প্রকল্প স্থলে সরাসরি গিয়ে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং সংলাপ হয় ফিন্ড ভিজিটের মাধ্যমে।
সামাজিক ব্যবসায় তরণদের এগিয়ে আসার আহব্বান জানিয়ে ইউনূস স্যার বলেন, ‘আমাদের তরুণ সমাজ সবচেয়ে শক্তিশালী। প্রযুক্তি তাকে অসীম ক্ষমতা দিচ্ছে। এখন তোমাদের শক্তিকে ব্যবহার করতে জানতে হবে। জেদ থাকতে হবে যে কোন কাজ করার জন্য। বাঁধা সরিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে সৃজনশীলতা। তিনি আরো বলেন, ‘দারিদ্র্যের জায়গা মানুষের সমাজে নয়, জাদুঘরে। একদিন তাই হবে। আর বেকারত্ব হচ্ছে আগ্রহ, যোগ্যতা ও সৃজনশীলতার অভাব’। ৩৩টি দেশে ৮৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে তাঁর নামে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে গবেষণা হচ্ছে তাঁর কাজ ও জীবনাদর্শ নিয়ে। সামাজিক ব্যবসার ওপর একাডেমিক কোর্স চালু হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনী অর্ন্তভুক্ত হয়েছে কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তকে। পৃথিবীর মাত্র ৭ জন ব্যক্তির একজন বাংলাদেশের ড. ইউনূস, যিনি একাধারে পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল।
২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক আয়োজন হয়েছিল তাঁর সামাজিক ব্যবসার থিমকে ধারণ করে, যেটিতে লোগো করা হয় থ্রি জিরো থিওরি নিয়ে। ড. ইউনূসের আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘ব্যাংকার টু দ্যা পুওর’ বইয়ের ছায়া অবলম্বনে তাঁরই ছাত্র আমিনুর রশিদ কাদেরী রচনা করেন একটি বই।
অর্থনীতিবিদ মু. সিকান্দার খান বলেন– ড. ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক ও দারিদ্র্য সম্পর্কে এই বই আমাদের ধারণা স্বচ্ছ করবে’। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন বাংলাদেশের মানুষ ও দেশের জন্য গর্ব ও আনন্দের। এই অভিনন্দিত অহংকার জাতিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে শেখায়’। (আমিনুর রশিদ কাদেরী: দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস)
মানুষ বেঁচে থাকে স্বপ্ন নিয়ে, তিনি বেঁচে থাকেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। সারা বিশ্বে তিনি বিপুল ও অভূতপূর্ব কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করতে চান। চান ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বৈষম্য আর পরিবেশ বির্পযয়ের অবসান ঘটাতে। এসবের জন্য তাঁর সংগ্রাম তাঁকে অনন্য করে তুলেছে সারা বিশ্বে। ৮৫তম জন্মদিনে তিনি তাই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক, আরও গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক
প্রাবন্ধিক, সংগঠক; আয়কর উপদেষ্টা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড