একজন সংগ্রামী মায়ের গল্প

তাহেরা বেগম | রবিবার , ১৪ মে, ২০২৩ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

১৯৪৪ সাল। চারিদিকে যুদ্ধ। হিন্দু মুসলমানদের সামপ্রদায়িক দাঙ্গা। কলকাতা শহরের বেলেঘাটার হলুদ রঙের একটি দোতলা বাড়ি। বাবাকে নিয়ে বেড়ে উঠছে ছয় ভাইবোনের মা হীন একটি পরিবার। সবার বড় বোন জুলি। লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী। ভাইবোন দের দেখাশুনা করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া তার জন্য বেশ কষ্টকর। একদিন দোতলা বাসাটা ভাড়া নিতে আসেন চট্টগ্রামের সনামধন্য বাদশামিয়া চৌধুরী, সোলাইমান চৌধুরী, .আর.নিজাম এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে M.Sc. (১৯৩৯) পাস করা আবদুল মোনায়েম চৌধুরী। প্রথম তিনজন বিবাহিত এবং ব্যবসার কাজে কলকাতা যেতেন। শেষজন ব্রিটিশ সরকারের চাকুরে। জুলির বাবা রেলওয়ে অফিসার। প্রথম তিনজন শেষজনের সাথে জুলির বিয়ের প্রস্তাব দেন। বিয়ের পর স্ত্রী নিয়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামের সরকার হাটের সাদেক নগর গ্রামে। স্ত্রীকে রেখে আবার চলে যান কলকাতায়। হঠাৎ গ্রাম দেখে জুলির জলে পড়ার অবস্থা। নেই কোনো ইলেক্ট্রিসিটি, ওয়াস রুম। তবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। চৌধুরী সাহেব প্রতি মাসে একবার চট্টগ্রামে আসতেন। দুই সন্তানের জননী জুলির দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল। দেশ বিভাগের পর ভাইবোন বাবা, স্বামীসহ চলে আসেন পাকিস্তানে। বিনিময় আইনে তারা ঢাকার ওয়ারিতে একটি বাড়ি পান। জুলির স্বামী পাকিস্তান সরকারের অধীনে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে উচ্চপদে চাকরি শুরু করেন। ট্রান্সফারের চাকরি, কখনো করাচি, কখনো লাহোর, কখনো ঢাকা সারা পাকিস্তান ঘুরে বেরাতে হল জুলিকে। সবশেষে চট্টগ্রাম। কিছুদিন ধরেই জুলি খেয়াল করে স্বামীর শরীর ভালো যাচ্ছে না। শরীরে কাল রোগ ধরা পড়ে। সেইসময় পাকিস্তান সরকার তাকে ব্রিটেনে হাইকমিশনার পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দুই বছর রোগের সাথে যুদ্ধ করে অকালে ঝরে পড়ে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। টাকা পয়সা রোগের পিছনে সব শেষ। জুলির জীবনে সত্যিকার যুদ্ধ শুরু হয়। সরকারি কোয়ার্টার ছাড়তে হয়। আত্নীয় স্বজন কেউই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেননি। তিনি কখনো সেলাই করে বা সেলাই শিখিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে শুরু করেন। সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের অধীনে দুঃস্থদের সেলাই শেখানোর কাজ পান। বিনিময়ে সামান্য টাকা দেয়া হত যেটা এতবড় পরিবারের জন্য কিছুই না। সংসারটি অসচ্ছলতায় ঢেকে আছে। দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী। তারপরও জুলি দমে যান নি। মহান আল্লাহ কে সঙ্গী করে পথ চলেছে। কঠিন সংগ্রামী নারী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যিনি ছিলেন বড় সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী। তিনি আজ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য অসীম সাহসী সংগ্রামী এক যোদ্ধা। তারপর ছেলে মেয়ে সবাই লেখাপড়া শেষ করেন। তবে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে দেশে বিদেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্যালুট এই নারীকে। মাত্র সায়ত্রিশ বছরে বিধবা হয়ে আট টি ছেলে মেয়ে নিয়ে এই মা যে সংগ্রাম করে গেছেন সেটা বোধহয় অনেকের চেয়ে ভিন্ন। এই মা শব্দে কেবল মায়া মমতা শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর ত্যাগের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার সারাজীবনের শ্রমের বিনিময়ে কারো কিছু দেয়ার থাকে না। তার ছেঁড়া আঁচলের তলায় তার হৃদয় ছেঁড়া ধনদের হাজারো বিপত্তির পর্বতমালা পেরিয়ে আপন আলোর ছটায় উদ্ভাসিত এই মা। তার দৃঢ় মনোবল, অদম্য সাহস আর হাজারো সততার বেড়াজালে যেন আবদ্ধ এক নারী। পাঠক! তিনি আমার মা। ধন্য মা তুমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচোখের জলে মাকে খুঁজি
পরবর্তী নিবন্ধআমার মা নিজেই একজন অমূল্য রত্ন