আমরা সবাই জানি, তিনি তিন সন্তানের জননী। কিন্তু তাঁর যে আরও একটি সন্তান আছে আমরা কি তা জানি? যাকে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা দিয়ে, অক্লান্ত পরিশ্রমে, নিঃস্বার্থ অর্থে এবং মানস আলোকে লালন–পালন করে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তাঁর সান্নিধ্যে থেকে জেনেছি তাঁর সেই সন্তানের নাম ‘চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব’। জীবদ্দশায় ক্লাব প্রসঙ্গে যখনই তাঁর সঙ্গে কথা হতো তিনি বলতেন, ‘চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব আমার আরেক সন্তান। সন্তানের মতো এ প্রতিষ্ঠানকে আমি ভালোবাসি। এর জন্য আমার সর্বোচ্চ দিয়ে যেতে চাই।’ সত্যিই তিনি আমৃত্যু অকাতরে শ্রম–ঘাম, মেধা, অর্থ বিসর্জন দিয়ে গেছেন এ সন্তানের জন্য। বলছিলাম একজন দক্ষ সংগঠক মানবিক মহীয়সী জিনাত আজম–এর কথা। এক সময় (এখনও) যার নাম চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবের পরিপূরক তথা সমার্থক হিসেবে চাউর ছিল। ‘জিনাত আজম’ বললেই একবাক্যে সবাই জানত তিনি চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব।
১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম নগর আজকের অবস্থায় ছিল না। চারদিকে অনুন্নত, অনগ্রসর, গ্রাম্য পরিবেশের ছাপ। সেই সময়ে স্থাপিত হয়েছিল মানবসমাজের কল্যাণে কিছু একটা করার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব। জিনাত আজম ১৯৭৯ সালে এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ক্লাবের সর্বোচ্চ পদ সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমে সম্পাদিকা হিসেবে (১৯৮৬–১৯৯৪ সাল) পরে সভাপতি হিসেবে (১৯৯৫–২০১৭ সাল) একটানা ৩২ বছর নিজেকে উজাড় করে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৩২ বছর! চাট্টিখানি কথা নয়। অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে এবং দৃঢ়তার সাথে পালন করেছেন বলেই এতটা বছর নেতৃত্বে থাকতে পেরেছিলেন। কতটা সাংগঠনিক দক্ষতা, কতটা মানবিক গুণাবলী ছিল তাঁর, কতটা গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি এতেই প্রমাণিত হয়। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার ছাপ আজও ক্লাবের অবয়বে পরিস্ফূটিত। তিনি যেমন ব্যক্তিগতভাবে উদারহস্ত ছিলেন তেমনি ক্লাবের মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অসহায় দরিদ্রদের কল্যাণে অকৃপণ হস্তে সাহায্য করেছেন। গড়ে তুলেছেন বালিকা সদন (এতিমখানা)। মানবিক মানুষের পক্ষেই এ ধরনের কাজ করা সম্ভব। বলাই বাহুল্য, তাঁর মননজুড়েই ছিল কেবল মানবকল্যাণ আর উপকার করা। যেখানে মানবতা বিশেষ করে নারীদের আত্মমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে সেখানেই তিনি সোচ্চার হয়েছেন, এগিয়ে এসেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। মানবতার কাণ্ডারির ভূমিকায় মূর্ত ছিলেন তিনি।
আমরা জানি, ‘জম্মিলে মরিতে হইবে’। অসহায়ের সহায়, এতিমদের পরমাশ্রয়, অন্ধকারে এক চিলতে আলো জিনাত আজমকেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। কিন্তু যাওয়ার আগে তিনি সন্তানকে একজন যোগ্য জননীর হাতে দিয়ে নির্ভার হতে চেয়েছিলেন। কতটুকু মমত্ববোধ থাকলে এমনভাবে ভাবতে পারেন! সন্তানকে তথা এ ক্লাবের অস্তিত্ব রক্ষায় যোগ্য হাতে তুলে না দিয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাননি। তাঁর সেই আশাটাও পূরণ হয়েছে। বর্তমান সভানেত্রী খালেদা আউয়ালের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। জীবদ্দশায় তিনি একদিন বলেন, ‘এবার আমি নির্ভার হলাম। নিশ্চিত হলাম যোগ্য একজনের হাতে আমার সন্তানকে তুলে দিতে পেরেছি।’
লেডিস ক্লাবের অভিভাবক জিনাত আজম ছিলেন প্রাণবন্ত অনন্য এক ব্যক্তিত্ব। চলনে বলনে এবং কার্যক্রমে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, বিনয়ী, ভদ্র–নম্র, নিরহংকার, হাস্যোজ্জ্বল এক আইকন। তাঁর নেতৃত্বের গুণ ছিল অতুলনীয়। তিনি লেডিস ক্লাব ছাড়াও লেখিকা সংঘের সভাপতি, চট্টগ্রাম একাডেমির জীবন সদস্য হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন। বেতার–টিভিতেও অংশগ্রহণের পাশাপাশি সভা–সেমিনারে, সাহিত্য–সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই তুলে ধরেছেন নারীদের, সমাজের নানা সংগতি–অসংগতির চিত্রকথা। কলম হাতেও সরব ছিলেন। রম্য কথনে স্খলিত সমাজের বিষাদগাথা ব্যঙ্গ করে শব্দরঙে এঁেকছেন। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাই ‘আমি তেলাপোকা বলছি’, ‘নজর আলীর সাতকাহন’ প্রভৃতি গ্রন্থের পরতে পরতে। দেশ–বিদেশের ‘সত্যম, শিবম, সুন্দরম’ কেচ্ছা–কাহিনীও পাঠকের সামনে অনবদ্য গদ্যে– ‘অন্য আলোয় অন্য ভুবন’, ‘অন্তরে বাইরে অনিকেত প্রান্তরে’সহ বিভিন্ন গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। মানবসমাজের ভালো–মন্দ, শুভাশুভ সরস কথনে তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। সব মিলিয়ে জিনাত আজম ছিলেন নিরলস–অক্লান্ত ও দক্ষ সংগঠক, রম্যসাহিত্যিক– যার জুড়ি মেলা ভার।
এমন মানবদরদী মানুষটিকে আর দেখা যাবে না, তাঁর সাহায্যের উদারহস্ত আর স্পর্শ করা যাবে না, ভাবতেই মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে, দুচোখে আষাঢ়–শ্রাবণ ঝরে। আমাদের দুচোখে বর্ষা নামিয়ে গত ১৪ই জুন দিবাগত ভোররাতে চিরঘুমে হারিয়ে যান। কী সুন্দর শান্তির ঘুম! আহা ঘুম! ঘুমের কাছে কি সেদিন মৃত্যুর পরাজয় ঘটেছিল নাকি মৃত্যুর কাছে ঘুম! কে জানে। জানি না। সেটা বোঝা বা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য বৈকি। তবে এটুকু বলতে পারি, মর্ত্যে কখনো যে–ঘুম কেউ আর ভাঙাতে পারেনি সে–ঘুম ঘুমপরিরা ভাঙাবেন জান্নাতুল ফেরদাউসে। তিনি জেগে উঠে দেখবেন কী সুন্দর এক পরিবেশে আল্লাহর মেহমান হয়ে আছেন। আমরা তাই প্রার্থনা করি তিনি সেখানেই অনন্তকাল থাকুন।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক–গণমাধ্যমকর্মী।