পৃথিবীর ৬’শ কোটি মানুষের মধ্যে ১২০ কোটি আমরা গর্বিত মুসলমান। কিন্তু মুসলমানদের যে প্রজ্ঞা, যে গুণাবলী থাকা উচিত তা আমাদের কাছে আছে বলে মনে হয় না। পশ্চিমা সংস্কৃতির ভয়াল থাবায় পর্যদুস্ত পৃথিবীর অপরাপর সংস্কৃতি। অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার বেড়াজালে আটকে পড়ে আছে তামাম দুনিয়ার মানুষ। সততা, নিষ্ঠা, পরোপকারিতা, আমানতদারী, সত্যবাদিতা, আচরণ, শৃঙ্খলা-বিধি সবকিছুতেই যেন পশ্চিমেরা এগিয়ে। যে গুণাবলী দেড় হাজার বছর আগে বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মানুষ, সমস্ত পয়গম্বরদের সর্দার, নবীকূল শিরোমনি আমার রাসূল (সা.) এর মাঝে বিদ্যমান ছিল তা যেন এখন তাঁর প্রিয় উম্মতদের মাঝে অনুপস্থিত আর এ গুণাবলী বহন করে চলেছে পশ্চিমেরা। মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য, বিভেদ আর বিভ্রান্তি যেন লেগেই আছে। বর্তমান পৃথিবীতে যে গৃহযুদ্ধ চলছে যেমন : সিরিয়া, ইয়েমেন, সৌদি আরব সবগুলো মুসলমানদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত। মুসলমানদের উপর যেমন বিশ্বের পরাশক্তিগুলো হামলে পড়ছে, তেমনিভাবে নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিভেদের কারণে পরাস্ত হচ্ছে হাজারো মুসলমান নাগরিক। একজন মুসলমান হিসাবে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি এ জন্য যে, পৃথিবীর প্রথম আদি মানব ছিল মুসলমান। সমস্ত নবী পয়গম্বরেরা মুসলমান হিসাবে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে গেছেন। একজন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মুসলমান হিসাবে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু পরবর্তীতে তার পিতা মাতা তাকে ধর্মান্তরিত করে। বিশ্ব নবী ছিলেন সমস্ত ধর্ম ও সম্প্রদায়ের জন্য আলোকবর্তিকা স্বরূপ। পারস্পরিক ধর্মীয় সম্প্রতির জন্য তিনি ছিলেন উত্তম আদর্শ আর সে জন্যেই ইহুদি, খ্রীষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলিমদেরকে নিয়ে গঠন করেছিলেন মদিনা রাষ্ট্র-যেটা যুগ যুগ ধরে মাইলফলক হয়ে থাকবে। পৃথিবীর মুসলমানরা আজ নিগৃহীত, কঠিন যাঁতাকলে নিষ্পেষিত। মুসলমানদের যে গুণাবলী থাকা দরকার তার অধিকাংশই অনুপস্থিত আমাদের জীবনে। মহান রাব্বুল আ’লামিন মুসলমানদের জন্য দু’টি সূরাই নাযিল করেছেন : সূরা আল্-মুমিনুন ও সূরা আল্-মোমেন। সূরা আল্-মুমিনুন এ মুসলমানদের গুণাবলী সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে (সেসব) ঈমানদার মানুষরা মুক্তি পেয়ে গেছে-যারা নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত থাকে, যারা অর্থহীন বিষয় থেকে বিমুখ থাকে, যারা (রীতিমতো) যাকাত প্রদান করে, যারা তাদের যৌন অংগসমূহের হেফাযত করে, তবে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী, কিংবা (পুরুষদের বেলায়) নিজেদের অধিকারভুক্ত (দাসী)-দের ওপর (এ বিধান প্রযোজ্য) নয়, (এখানে যৌন অংগসমূহের হেফাযত না করলে) কখনো তারা তিরস্কৃত হবে না, অতপর এ (বিধিবদ্ধ উপায়) ছাড়া কেউ যদি অন্য কোনো (পন্থায় যৌন কামনা চরিতার্থ করতে) চায়, তাহলে তারা হবে সীমালংঘনকারী, যারা তাদের (কাছে রক্ষিত) আমানতও (অন্যদের দেয়া) প্রতিশ্রুতিসমূহের হেফাযত করে, যারা নিজেদের নামাযসমূহের ব্যাপারে (সমধিক) যত্নবান হয়, এ লোকগুলোই (হচ্ছে মূলত যমীনে আমার যথার্থ) উত্তরাধিকারী’-সূরা আল্ মুমিনুন ১-১০। এভাবে আল্লাহতায়ালা মুসলমান তথা মুমিনদের গুণাবলী সম্পর্কে বিধৃত করেছেন। আর ওদিকে আমাদের আচার-ব্যবহার, দৈনন্দিন আয়-ব্যয় ইত্যাদি সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘দয়াময় (আল্লাহ তায়ালা)-এর বান্দা তো হচ্ছে তারা, যারা যমীনে নেহায়াত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন জাহেল ব্যক্তিরা (অশালীন ভাষায়) তাদের সম্বোধন করে, তখন তারা নেহায়াত প্রশান্তভাবে জবাব দেয়, যারা তাদের মালিকের উদ্দেশ্যে সাজদাবনত হয়ে ও দণ্ডায়মান থেকে (তাদের) রাতগুলো কাটিয়ে দেয়। যারা বলে, হে আমাদের মালিক, তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাব দূরে রেখো, কেননা তার আযাব হচ্ছে নিশ্চিত বিনাশ, (তদুপরি) আশ্রয় ও থাকার জন্যে তা হবে একটি নিকৃষ্ট জায়গা ! তারা যখন ব্যয় করে তখন অপব্যয় (যেমন) করে না, (তেমনি কোনো প্রকার) কার্পণ্যও তারা করে না, বরং তাদের ব্যয় (সব সময় এ দুয়ের) মধ্যবর্তী (একটি ভারসাম্যমূলক) অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে’-সূরা আল্-ফোরকান ৬৩-৬৭।
একজন মুসলমানের হৃদয় থাকবে আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত, সদা জাগ্রত। আল্লাহর কোরআনের আয়াত শুনলেই তাঁর কেঁপে উঠবে মন-এটিই একজন মুমিনের প্রকৃত গুণাবলী হওয়া উচিত। সেটাই আল্লাহতায়ালা বলছেন এভাবে, ‘আসলে মোমেন তো হচ্ছে সেসব লোক, (যাদের) আল্লাহ তায়ালাকে যখন স্মরণ করানো হয় (তখন) তাদের হৃদয় কম্পিত হয় এবং যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, উপরন্তু তারা তাদের মালিকের ওপর নির্ভর করে, যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদের যা কিছু (অর্থ-সম্পদ) দান করেছি তা থেকে তারা (আমারই পথে) খরচ করে, এ লোকগুলোই হচ্ছে সত্যিকার মোমেন, তাদের মালিকের কাছে তাদের জন্যে (বিপুল) মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা (-র ব্যবস্থা) রয়েছে’-সূরা আল্-আনফাল ২-৪।
একজন মোমেন বা মুসলমান হতে হবে আল্-কোরআনের আলোয় আলোকিত। পবিত্র কোরআনের প্রতিটি বর্ণ ও প্রতিটি শব্দকে নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এতেই রয়েছে একজন মুমিন এর জীবনের সার্বিক সফলতা। মুসলমানদের গুণাবলী স্থানান্তর হয়েছে পশ্চিমাদের জীবনে-তাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে। সততা ও সত্যবাদীতা ও আমানতদারী খুব একটা দেখা যায় না আমাদের মুসলমানদের জীবনে আর এটাই রপ্ত করে নিয়েছে পশ্চিমা দেশের মানুষেরা। আবারও আমরা ফিরে যেতে চাই সেই মদিনার দেশে, যেখানে আমার রাসূল (সা.) গড়ে তুলেছিলেন সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য এটি অনুকরণীয় আদর্শ। যে আদর্শকে লালন করলেই হওয়া যাবে প্রকৃত মুসলমান তথা মুমিন আর মুমিনদের জন্যেই রয়েছে জান্নাতের সু-সংবাদ।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)