একজন দৃঢ়চেতা অরুন্ধতী রায়

রিতু পারভী | শনিবার , ৬ জুলাই, ২০২৪ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

সব সমাজেই প্রতিরোধ ও মাথা না নোয়ানোর এমন এক সংস্কৃতি থাকা দরকার যা দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের (পুঁজিবাদী, কমিউনিস্ট কিংবা গান্ধীবাদী যাই হোক না কেন) অনিবার্য লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে জনগণ রুখে দাঁড়াতে পারে।”

ম্যান বুকার বিজয়ী জনপ্রিয় লেখক অরুন্ধতী রায়ের উপরের উক্তি থেকে এটা পরিষ্কার যে তিনি একজন রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সচেতন প্রতিবাদী লেখক। সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার যেকোন সিদ্ধান্তের ঘোরতর বিরোধী অরুন্ধতী সর্বদা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। বারবার মুখোমুখি হতে হয়েছে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের। অতি সম্প্রতি চৌদ্দ বছর আগে দেওয়া এক বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে নতুন করে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানোর আয়োজন হয়েছে। ইউএপিএ বা সন্ত্রাস দমন আইনে কাশ্মীরের স্বাধীনতা নিয়ে করা এক বক্তৃতার জের ধরে অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার অনুমতি দিয়েছেন দিল্লির উপরাজ্যপাল বিনয় কুমার সাক্সেনা। অনুমতি দেয়ার ঠিক দশ দিনের মাথায় তাঁকে দেয়া হয় যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশের লেখকদের মধ্যে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য পুরস্কার ‘পেন পিন্টার’। এই পুরস্কার দেওয়া হয় অরুন্ধতী রায়ের সাহিত্যে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের জন্য। অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার জন্য যখন ভারতের সরকার চৌদ্দ বছর পুরনো বক্তৃতাকে নতুন করে সামনে আনার চেষ্টা করছিল, অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবেকবান মানুষ যখন এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে ‘পেন পিন্টার’ পুরস্কার সেদেশের সরকারকে খানিকটা চাপের মধ্যে ফেলেছে।

অরুন্ধতী রায় যখন লিখেন

জাতিভেদের উদ্দেশ্যই হলো মানুষে মানুষে এমন ভেদাভেদ সৃষ্টি করা যাতে কোনোভাবেই মানুষ আর একতাবদ্ধ হবার উপায় পায় না। কারণ নিচু জাতির মধ্যে আবার গোত্র আছে, আরো ভাগ আছে। সবাইকে এই আধিপত্যের ক্রমানুসারে গঠিত, পরস্পর বিচ্ছিন্ন গণ্ডিবদ্ধ সমাজ রক্ষার কাজে লাগানো হয়েছে। এই হলো শ্রেণি, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম অনুযায়ী ছক তৈরির রাজনীতি। সেই ছককে আরো সূক্ষ্মভাগে ভাগ করাটা গোটা পৃথিবীকে অধীনে রাখার অপরিহার্য অংশ। মানুষকে এই কথা বলে বশীভূত রাখা: ‘তুমি মুসলমান, তুমি হিন্দু, তুমি শিয়া, তুমি সুন্নি, তুমি বারেলভি, তুমি ব্রাহ্মণ, তুমি দলিত, তুমি সমকামী, তুমি অপর লিঙ্গের প্রতি আসক্ত, তুমি লিঙ্গত্যাগী তাই তুমি শুধু নিজের পক্ষেই কথা বলতে পারো, কারো সাথে ঐক্যবদ্ধ হবার কোন পথ নেই।’ অর্থাৎ মানুষ যাকে মুক্তি ভাবছে সেটা বাস্তবে দাসত্ব…”

তখন শ্রেণি বিভক্তির বিরুদ্ধে, শোষণ জুলুমের বিরুদ্ধে, আগ্রাসীবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁর কলম তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে। একজন মানবতাবাদী, রাজনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশ সচেতন অরুন্ধতী রায় সাধারণ মানুষের কাতারে থেকে নিজের চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন দৃঢ়ভাবে, কোনো শক্তির কাছে নত না করে। যুদ্ধ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট এবং আপসহীন। ‘পেন পিন্টার’ পুরস্কার ঘোষণাকালে পেন এর চেয়ারম্যান রুথ ব্রোকউইক তাই অরুন্ধতী রায় সম্পর্কে বলেন, ‘অরুন্ধতীর লেখায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকলেও তিনি সত্যিকারের একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী চিন্তাবিদ এবং তাঁর শক্তিশালী কণ্ঠকে স্তব্ধ করা যাবে না।’

পেন পিন্টার পুরস্কার, ২০২৪ বিজয়ী অরুন্ধতী রায় তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের জন্য সকলের কাছে আদৃত। মানবতা বিরোধী যেকোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার অরুন্ধতী মানুষকে উজ্জীবিত করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবয়স যখন চল্লিশ
পরবর্তী নিবন্ধলালানগর ইউপির চেয়ারম্যান পদে পাঁচ প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ