এই বিজয় গণতন্ত্রের, এই বিজয় জনগণের

ড. মো. মোরশেদুল আলম | মঙ্গলবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ

৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু পরিবেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন হচ্ছে মানুষের নিকট রাজনৈতিক দলের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের একমাত্র উপায়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার পাঁচ বছরে দেশের জনগণের জন্য কী করেছে, মানুষ কী পেয়েছে তা পরীক্ষার সুযোগ পাওয়া যায়। নির্বাচন না হলে অসাংবিধানিক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হবার ঝুঁকি থাকে এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় শূন্যতা পরিলক্ষিত হয়। এতে করে জনগণের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, উন্নয়নে বিঘ্নতা সৃষ্টি হয়। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে নানা ধরনের অস্থিরতা, নৈরাজ্য, অশান্তির ভেতর দিয়ে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য কোনো কোনো মহল তাদের সর্বশক্তি দিয়ে অপপ্রয়াস চালায়। তাই উন্নয়নশীল দেশে সুষ্ঠুভাবে একটি জাতীয় নিবৃাচন সম্পন্ন করা চ্যলেঞ্জের কাজ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। গত ২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনাবলির পর বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো লাগাতার অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। একইসঙ্গে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ ও রেলপথেও নাশকতা করছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। দায়িত্ব পালনরত একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যাকাণ্ডের যে বীভৎস দৃশ্য দেশবাসী দেখেছে, তা তাদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আবার হাসপাতালে সংঘর্ষকারীদের হামলা সংঘর্ষের মাত্রাকে ভিন্ন খাতে নিয়েছে। এসব ঘটনাই কিন্তু আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। গাড়িতে অগ্নি সংযোগের সময় পেট্রোলবোমাসসহ ধরা পড়ছে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

আধুনিক জাতিরাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে গঠিত রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের ফলে ঐতিহ্যগত নির্বাচন পদ্ধতির রূপান্তর ঘটেছে। নির্বাচন এখন গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সূচনালগ্ন থেকেই বাংলার জনগণ নির্বাচনে উৎসাহী হয়ে ওঠে। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র অঙ্গাঅঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত একথা সর্বজনবিদিত। নোবেল বিজয়ী অর্মত্যসেন ১৯৯৯ সালে তাঁর ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন; বৈষম্য ও গোত্রে গোত্রে সংঘাত এড়ানো এবং দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানোর জন্য কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আবশ্যক। তিনি লিখেছেন, গণতন্ত্রের ঘাটতি রেখে টেকসই উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে জরুরি উপদান হলো বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনগৃহীত নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন। ৭ তারিখের নির্বাচনকে ঘিরে অনেক অপচক্রান্ত হয়েছে। জ্বালাওপোড়াও করে, নাশকতা চালিয়ে, সহিংসতা ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশের সাধারণ জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো বঞ্চিত করতে চেয়েছিল।

বিএনপি ও দলটির সঙ্গে যুক্ত আন্দোলনে থাকা দলগুলোর ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের আগের রাতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ঠেকাতে ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে রাজধানীর গোপীভাগে ৫ জানুয়ারি রাতে বেনাপোল এক্সপেস ট্রেনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় দুই শিশুসহ চারজন নিহত এবং ৩০ জনেরও অধিক আহত ও দগ্ধ হয়েছে। বিএনপির আন্দোলন চলাকালে এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর ভোরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে চলন্ত অবস্থায় আগুনে মাসন্তানসহ চারজন নিহত হয়। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুরে কাটা রেললাইনে লাইনচ্যুত হয়ে একজন নিহত হয়। কক্সবাজারের রামুতে অবস্থিত ইউ চিট সান (রাখাইন) বৌদ্ধ মন্দিরের মূল অংশে ৬ জানুয়ারি রাতে দুবৃত্তরা আগুন দেওয়ায় পুড়ে গেছে মন্দিরের কাঠের সিঁড়ি। এই ঘটনাগুলো বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংস রাজনীতির কদর্য রূপ আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। নির্বাচনকে ভন্ডুল করতে হরতালঅবরোধের নামে যাত্রীবাহী বাসট্রাকে অগ্নিসংযোগ, বাস হেলপারদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, রেললাইন উপড়ে ফেলা এবং ট্রেনের বগিতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের মতো নাশকতা সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনী জনসভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে আপনাদের সাংবিধানিক অধিকার তথা ভোটের অধিকার, যেটা মিলিটারি ডিকটেটররা কেড়ে নিয়েছিল এবং আমরা যেটা ফিরিয়ে এনেছি, সেই অধিকার প্রয়োগ করবেন। আজ বাংলাদেশের মানুষ তাদের এই অধিকার সম্পর্কে সচেতন। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমরা ২০২৪ সালে পা দিয়েছি। এই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই বাংলাদেশের এত উন্নতি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের শক্তি দেশের জনগণ। মানুষকে নিয়েই আমরা রাজনীতি করি। আওয়ামী লীগ এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন। এই সংগঠন বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। বাঙালি জাতি তাদের জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে বিজয় এনে দিয়েছে। বিশ্বের দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে চলতে চাই।’

রাজনীতি হতে হবে কল্যাণমুখী ও জনবান্ধব। জ্বালাওপোড়াও এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ কখনোই ভালো চোখে দেখে না। সরকারের ভালো কাজের সমর্থনের মানসিকতা রাজনীতিবিদদের মধ্যে থাকতে হবে। রাজপথ বন্ধ করে নয়, বরং রাজপথ উন্মুক্ত রেখেই রাজনীতিবিদদের গঠনমূলক রাজনীতি করতে হবে। রাজনীতিকদের সর্বোচ্চ সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে সর্বগ্রহণযোগ্য কর্মসূচি দিতে হবে। সাধারণ জনগণ এখন স্থিতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তখনই তা বাস্তবে রূপ নেবে, যখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা একটি স্থিতিশীল কাঠামোর ওপর দাঁড়াতে পারবে। রাজপথে অস্থিরতা সৃষ্টি করে শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্যসহ রাষ্ট্রের জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অপকৌশলে সাধারণ জনগণ বিশ্বাসী নয়। একের পর এক সহিংস পরিস্থিতির জন্য ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দলটি। আন্দালনের নামে মানুষ হত্যাকে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও ভালো চোখে দেখছে না। যারা এই নাশকতা করেছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এমন ঘটনা অমানবিক ও নৃশংস। নাশকতা ও সহিংসতায় আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা কখনোই আন্দোলনের ভাষা হতে পারে না। বিএনপি ও সমমনাদের এই আন্দোলনে সহিংসতা ছাড়া নতুন কিছু না থাকায় জনপ্রিয়তাও শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও কোনো নেতাকর্মী কিন্তু মাঠে নামছেন না।

প্রতিবার নির্বাচনের আগে বিএনপির জ্বালাওপোড়াও বন্ধে তরুণদের প্রথম ভোট মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি নৌকা প্রতীককে বেছে নিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি। এবারের নির্বাচনেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ভোট বন্ধের বহুবিধ ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে সকল শ্রেণি, পেশা, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদানের মধ্য দিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত করেছে। সিইসি এর মতে, প্রাথমিক হিসেবে সারাদেশে গড় ভোট পড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশের নির্বাচনের স্বচ্ছতায় রাশিয়াসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলো অভিভূত। বিদেশি পর্যবেক্ষক দল ব্রিফিংয়ে বলেছে, ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ সুষ্ঠু ও সবকিছু সুশৃঙ্খল ছিল। বিদেশি পর্যবেক্ষদের মূল্যায়ন হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক এবং কোনো অনিয়ম নেই বলে তাঁরা অভিমত দিয়েছেন। চ্যালেঞ্জ থাকলেও দলীয় সরকারের অধীনে ভোট সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে সিইসি মত দিয়েছেন।

বিএনপি ও সমমনাদের সকল বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদান করেছে। এই ভোট প্রদানের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ নাশকতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখিয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেশের জনগণসহ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি শক্তির অপতৎপরতাও কিন্তু দেশবাসী লক্ষ করেছে। এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশিবিদেশি বিভিন্ন এজেন্সি অপতৎপরতা চালিয়েছিল। দেশে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশিবিদেশি নানা সংগঠনগোষ্ঠী কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান নেয়। বিশেষত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোয় নির্বাচন প্রক্রিয়াটি নির্দিষ্ট একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচন ব্যবস্থাও সম্পন্ন হয় স্বাভাবিক নিয়ম মেনে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। এত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে রায় দিয়ে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ম্যান্ডেট দিয়েছে। আওয়ামী লীগের এই বিজয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার বিজয়, এই বিজয় জনগণের।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে বিদেশ যাত্রা : দেশের জন্য অশনি সংকেত
পরবর্তী নিবন্ধকৃষক পরিবারের ঐতিহ্য খড়ের গাদা