কি রে স্বাধীন এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেন? আজ তো পরীক্ষা শেষ হয়েছে। চল মাঠে একটু খেলি। কবে আবার স্কুলে আসব। কথাগুলো বলতে বলতে মাহীন স্বাধীনের কাছে এলো।
পাশে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খেতে খেতে শুভ বলল, এই স্বাধীন তুই তো খেলার জন্য পাগল। আজ চলে যেতে চাইছিস যে।
স্বাধীন তার প্রশ্নটি জ্যামিতি বক্সে ঢুকিয়ে বলল, না রে, তোরা খেল, আমি খেলতে পারবনা। আজ দেরি করা যাবে না। আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। গেলাম রে। রেজাল্ট এর দিন দেখা হবে। তোরা ভালো থাকিস। বলেই সে হনহন করে চলে গেল। মাহীন আর শুভ অবাক হয়ে ওর যাওয়ার পথে চেয়ে থাকলো।
দাদুভাই পরীক্ষা কেমন হয়েছে? স্বাধীনের দাদু নাতিকে জিজ্ঞেস করল। স্বাধীন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সে বোর্ড, জ্যামিতি বক্স টেবিলে রেখে বলল, ভালো দাদু। তখন ওর মা এসে স্বাধীনের স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করে দিয়ে বলল, সকালে তো স্নান করেছ এখন মুখ হাত ধুয়ে টেবিলে এসো। আজ কিন্তু দেরি করলে চলবে না। মনে আছে তো? স্বাধীন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
দাদু বলল, চলো দাদুভাই, আমরা খেয়ে একটু বিশ্রাম করে তারপর রওনা দেব।
দাদু আর কতদূর? উফ্ আমার যে আর তর সইছে না। রিকশায় দাদুর পাশে বসে কথাগুলো বলল স্বাধীন। দাদু বলল, এই তো প্রায় চলে এসেছি। একটু ধৈর্য ধরো দাদুভাই। এরপর ওরা দুজন জুতা খুলে খালি পায়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। দাদু হাত উপরে তুলে স্যালুট জানালো। দাদুকে দেখে স্বাধীনও স্যালুট জানালো। দাদু দেখে খুশি হলো। ওরা দুজন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালো। হঠাৎ দাদু উপরের দিকে তাকিয়ে বললেন –
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,
ভয় নাই, ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।”
স্বাধীন দাদুর দিকে চেয়ে রইল। সে খুব গর্বিত বোধ করে যে তার দাদু একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তারপর ওরা দুজন পুরো জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। স্বাধীন দাদুকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা দাদু, আজকের দিনে প্রতিবছর তুমি এখানে আসো কেন? আমাকে তো এই প্রথম আনলে।
দাদুর চোখ ছলছল করে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এই দিনে আমি আমার খুব ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুকে হারিয়ে ছিলাম। দেশ প্রায় স্বাধীনের পথে। কিন্তু দেশের কিছু বেঈমানের জন্য ওদের হারিয়ে ফেলেছি।
স্বাধীন বলল, দাদু স্মৃতিসৌধ মানে কি? দাদু বলল, স্মৃতিসৌধ হলো কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার স্মরণে নির্মিত একটি স্থাপনা। এর মূল উদ্দেশ্য হলো স্মৃতি সংরক্ষণ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা ব্যক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। যেমন ধরো আমার বন্ধুরা সহ আরো লাখ লাখ বাঙালি যাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা আনলো তাঁদেরকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। জানো দাদুভাই, আমাদের দেশে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মিত একটি প্রধান স্মৃতিসৌধ। এটি সাতটি ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল দিয়ে গঠিত এবং এর উচ্চতা ১৫০ ফুট।
স্বাধীন অবাক হয়ে শুনছে দাদুর কথা।
তারপর সামনে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ঐ দেখ দাদু জলাশয়।
দাদু বলল, হ্যাঁ রে, ঐটা অশ্রু বা শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতীক।
আর এই যে ঐদিকে দেখ গণকবর রয়েছে, যা শহীদদের আত্মদানের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়।
স্বাধীন আর একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, দাদু, এই স্মৃতিসৌধের চারপাশে সবুজ ঘাসে ভরা। কী সুন্দর লাগছে!
দাদু হেসে উত্তর দিলেন, এই সবুজের বেষ্টনী বাংলাদেশের সবুজ–শ্যামল প্রকৃতির প্রতীক।
তারপর সে দাদুর পাশে এসে হাত ধরে বলল, আচ্ছা দাদু, এটা কখন কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
দাদু ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, বলছি দাদুভাই, আগে চলো আমরা ঐ পাশে বসি।
দাদু দেখলো, কিছু ছেলে যারা এতোক্ষণ ওখানে খেলছিল ওরাও দাদুর চারপাশে এসে বসলো।
দাদু বলা শুরু করলো, এর স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, জানো তোমরা, মোট ৫৭ টি নকশার মধ্যে থেকে তরুণ স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের নকশাটি গৃহীত হয়। সবাই মনোযোগ দিয়ে দাদুর কথা শুনছে।
দাদু বলেই চলেছেন, ১৯৮৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করা হয়। এই জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লে. জে. হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, ১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। জাতীয় স্মৃতিসৌধের অপর নাম হলো “সম্মিলিত প্রয়াস”। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া বীরদের স্মরণে নির্মিত একটি প্রতীকী সৌধ।
একটা ছেলে স্মৃতিসৌধের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আচ্ছা দাদু আমি শুনেছিলাম এই যে সাতটি দেয়াল আছে তার অর্থ আছে?
দাদু ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম কি, আর কোন ক্লাসে পড়?
ছেলেটি মাথা চুলকিয়ে বলল, দাদু আমি সুমন। আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে আর পড়তে পারিনি। এখন একটা গ্যারেজে কাজ করি।
দাদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ও আচ্ছা। তোমার জানার আগ্রহ দেখে খুব ভালো লাগছে। তুমি ঠিক শুনেছো। এই দেয়ালগুলো ছোট থেকে ক্রমান্বয়ে বড়ক্রমে সাজানো হয়েছে। এই সাত জোড়া দেয়াল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে।
এগুলো হলো – ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ এর সংবিধান আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ–অভ্যূত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে।
স্বাধীন আর ছেলেগুলো নীরব হয়ে দাদুর কথাগুলো শুনছিলো।
এরপর দাদু উঠে বললেন, চলো দাদুভাই সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তোমরাও এসো। আমরা সবাই মিলে একটা দেশের গান গেয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
“এক নদী রক্ত পেরিয়ে
বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা
তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না
না, না, না, শোধ হবে না
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
সাত কোটি মানুষের জীবনের সন্ধান আনলে যারা
সে দানের মহিমা কোনোদিন ম্লান হবে না
না, না, না, ম্লান হবে না।”







