এইসব অভিশাপ নিয়ে…

ফুয়াদ হাসান | সোমবার , ২৮ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ

মারিনা আব্রামোভিচের কথা আমরা সকলেই জানি। ১৯৭৪ সালে বিশ্ববাসীকে এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন সার্বিয়ার এই পারফর্মিং আর্ট শিল্পী। মানুষ যে প্রকৃত অর্থেই কতটা ভয়ানক হিংস্র তার একটা পরিচয় মেলে ঘটনাটির মাধ্যমে। অন্য দেশের নাগরিকদের কথা বাদই দিলাম, সেদিক থেকে আমরা বাঙালিরা কিন্তু আরও একধাপ এগিয়ে।

সামপ্রতিক রাজধানীর একটি স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আবার নতুন করে বেরিয়ে আসলো আমাদের চরিত্র। আমরা জাতি হিসেবে কতটা অবিবেচক, অমানবিক, হুজুগে তার নানা চিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

তার মধ্যে একটি ঘটনাতো আমাদের মানবিক মূল্যবোধ নিয়েতে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলছে! স্কুল ভবনে বিমান বিধ্বস্তের পর পুড়ে যাওয়া শিশুদের মধ্য থেকে দগ্ধ একটি শিশু হেঁটে বেরিয়ে আসছে তখন আশেপাশের একদল লোক কেবল ভিডিও করছে ঘটনাটা। যেন এটাই যেন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

ঘটনার আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, হাসপাতালে নেয়ার জন্য একটা গাড়িও পাওয়া যায় না, কোন সিএনজি, প্রাইভেট গাড়ি আহতদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে না অথচ আমাদের মহান রাজনৈতিক নেতারা দল বেঁধে, বাকিদের জন্য রাস্তা বন্ধ করে, কে কার আগে হাসপাতালে অনুপ্রবেশ করবে তার একটা প্রতিযোগিতা নেমে গেলেন। এই সময় এই কাজগুলো করা যে কতটা অবিবেচকের তা মহানদের মাথায় কী একবারও ঢুকলো না! হাসপাতালের আইসিইউতে ঢুকে মৃত্যুপথযাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাই আমাদের গণ্যমান্যদের যেন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর এমন যে কোন একটা ঘটনা ঘটলেই সরকার প্রথমত চায় বিষয়টাকে ধামাচাপা দিতে! নিহতআহতদের সংখ্যা লুকানোর চেয়ে যেদিকে বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার সেদিকে কখনই কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। সত্যিকার অর্থে কোন তদন্ত হয় না একটি দুর্ঘটনারও, বেরিয়ে আসে না প্রকৃত কারণ, কে দোষী বা এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোন দায় ছিল কিনা সেসব নিয়ে কোন আন্তরিক পদক্ষেপও চোখে পড়ে না। কিংবা এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে যেন আর এমন কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে কোন দায়িত্বশীল আচরণ রাষ্ট্রের কোন অংশ থেকেই নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।

ঈদরোজা বা যেকোন উৎসব আসলেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়ার অভ্যাস আছে আমাদের ব্যবসায়ীদের। ঈদেচাঁদে গাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার প্রবণতাও আমাদের মজ্জাগত। কিন্তু তাই বলে আহত পুড়ে যাওয়া শিশুদের জন্য একবোতল পানিও স্কুল ক্যান্টিন থেকে কিনতে হবে ছয়শো টাকা মূল্যে। এতটা নিচে নেমে গেছি আমরা, এতই নিষ্ঠুর হয়ে গেছে আমাদের মন, মনন। এখানে সবকিছুর মূল্য আছে শুধু মানুষেরই কোনো মূল্য নেই। তাই জনৈক আহতের বাবা জনসম্মুখে চিৎকার করে বলেন, ‘দেশে আমরা আর থাকবো না‘! একটি দেশের সাধারণ জনগণ কতটা অসহায় হলে এমন কথা বলে, দেশের প্রতি কতটা ক্ষোভ, ঘৃণা জমা হলে মুখ দিয়ে এমন কথা উচ্চারিত হয়! একটি জাতির জন্যে, একটি দেশের জন্যে এরচেয়ে লজ্জার, অপমানের আর কী হতে পারে!

আগের আমলে এসব নাহয় হয়েছে কিন্তু নতুন বিপ্লবের পরেও কেন তবে সরকারকে মিথ্যা বলতে হবে মৃত্যুসংখ্যা নিয়ে, লুকাতে হবে লাশ! চব্বিশের যে সব সন্তানদের আত্মত্যাগে আজকে যাঁরা রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তাঁরাওতো ঐসব আহতদের চিকিৎসার সুব্যবস্থার কোন উদ্যোগ নেন নি। এমন কী তাদের সাথে আচরণও ছিল অসংযত।

আমরা যারা যে ভাবেই ক্ষমতায় যাই না কেন তার অপব্যবহার করি। তা সে ছোটবড় যেকোন ক্ষেত্রেই হোক। আমাদের এই চিরায়ত মজ্জাগত সমস্যা হয়তো আর কোনদিনই ভালো হবে না!

হুমায়ুন আজাদ বহু আগে এ জাতিকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘বাঙালি একটি রুগ্‌ণ জনগোষ্ঠী। এখানে সবকিছুই নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে, সবকিছু ভেঙে পড়েছে। এখানে যেই ক্ষমতায় যায় সেই বিদেশে টাকা পাচার করে, সম্পদ কুক্ষিগত করে। এতো লাশের বিনিময়ে যে বিপ্লব বা নতুনরূপে শুরু করার সুযোগ ঘটেছিল, তাও কি তবে ছিনতাই হয়ে গেছে!

পূর্ববর্তী নিবন্ধরিক্ত
পরবর্তী নিবন্ধনামহীন জলচিহ্ন