দেশে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে আশার কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল। দলটি এক ধরনের উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া এডিস ইজিপ্টাই মশায় ব্যবহার করে সফল হয়েছেন, যা ঢাকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। ফলে এই নিরাপদ এবং জৈবিক পদ্ধতিটি বাংলাদেশে ডেঙ্গু এবং মশাবাহিত অন্য রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হবে বলে আশা করছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি।
গতকাল বুধবার আইসিডিডিআর,বি জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার কিউআইএমআর বার্গহোফার মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আইসিডিডিআর,বি ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে এই গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী দ্য নেচার এর সায়েন্টিফিক রিপোর্টস–এ প্রকাশ হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
উলবাকিয়া প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ফলের মাছি ও কিছু মশার দেহে স্বাভাবিকভাবেই থাকে। কিন্তু এডিস মশায় থাকে না। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষ বা প্রাণীকে সংক্রমিত করতে পারে না। তবে তা এডিস মশায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করে। আইসিডিডিআর,বি বলেছে, এডিস মশার শরীরে উলবাকিয়া প্রবেশ করিয়ে দুটি কৌশলে মশাবাহিত ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রথমটিতে উলবাকিয়াবাহী পুরুষ এডিস ইজিপ্টাই মশা পরিবেশে ছাড়া হয়। এই পুরুষরা স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হয়। এতে স্ত্রী মশার ডিম ফোটে না তাই মশার সংখ্যা কমে যায়।
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় মশা প্রকৃতিতে ছাড়া হয়। উলবাকিয়াবাহী স্ত্রী এডিস ইজিপ্টাই মশারা একই প্রজাতির অন্য মশাদের মধ্যে উলবাকিয়া ছড়িয়ে দেয়। তারা উলবাকিয়াবাহী বা উলবাকিয়াবাহী নয় এমন পুরুষ এডিস মশাদের সঙ্গে মিলিত হলেও তাদের বংশধর উলবাকিয়া বহন করে।
যেভাবে হয়েছে পরীক্ষা : আইসিডিডিআর,বি বলেছে, তাদের গবেষণায় ডব্লিউএএলবিবি নামে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার একটি ধরন ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ঢাকার উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার উপযোগী। গবেষকরা প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার কিউআইএমআরবি রিসার্চ সেন্টারে সংরক্ষিত উলবাকিয়াবাহী এডিস ইজিপ্টাইকে ঢাকা থেকে নেওয়া মশার সঙ্গে সংকরায়ন করেন। একাধিক প্রজন্মের প্রজননের মাধ্যমে তারা ডব্লিউএএলবিবিটু–ঢাকা নামে উলবাকিয়াবাহী এই মশার একটি ধরন তৈরি করেছেন। এই ধরনটি তাদের ডিমের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে দিতে সক্ষম।
গবেষণা দলটি ডব্লিউএএলবিবিটু–ঢাকা নামে উলবাকিয়াবাহী এডিস ইজিপ্টাই মশার ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষমতা মূল্যায়ন করেছে। ফলাফলে দেখা গেছে, উলবাকিয়াবাহী নয় এমন মশার তুলনায় এই মশাগুলো ডেঙ্গু সংক্রমণের ক্ষমতা ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ কমিয়ে দিতে সক্ষম। গবেষকরা পরীক্ষাগারের খাঁচায় আবদ্ধ অবস্থায় এই মশাগুলোর প্রজনন ক্ষমতা, উর্বরতা ও টিকে থাকার ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এতে দেখা গেছে, ঢাকার জন্য অভিযোজিত এসব ভালো মশা টিকে থাকা ও প্রজননের ক্ষেত্রে স্থানীয় মশাগুলোর সমান সক্ষম।
আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, পরিবেশে মশা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ থাকতে পারে, কিন্তু এগুলো জিনগতভাবে পরিবর্তিত নয়। এগুলো হলো ভালো মশা। তিনি বলেন, এদের দেহে রয়েছে প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া। গবেষণায় প্রমাণিত যে এটি ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী। উলবাকিয়া অনেক দেশেই নিরাপদে ব্যবহার হয়েছে এবং এটি ডেঙ্গু ও এই ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য নতুন পথ খুলে দিতে পারে।
গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক হাসান মোহাম্মদ আল–আমিন বলেন, এই গবেষণা বাংলাদেশের জন্য মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা পরিচালনার ভিত্তি তৈরি করেছে। যদিও পরীক্ষাগারের ফলাফল আশা জাগানিয়া। তবে বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়নের জন্য সতর্ক পরিকল্পনা ও পরীক্ষা প্রয়োজন।
আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, উলবাকিয়াবাহী মশা ব্যবহারের এই সম্ভাবনাময় পদ্ধতির সফল প্রয়োগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষায় সরকারকে সহায়তা করতে আইসিডিডিআর,বি প্রস্তুত। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ের সফল পরীক্ষার পরেই কেবল এটিকে ব্যাপকভাবে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করা উচিত। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা ডেঙ্গু টিকা গবেষণায়ও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। স্থানীয় পরীক্ষার মাধ্যমে টিকা প্রাপ্তি ত্বরান্বিত করতে সরকারের সাথে কাজ করার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী যা দেশের ডেঙ্গু সমস্যার একটি সমন্বিত সমাধান দিতে পারবে।