আনন্দ বেদনা প্রকাশের খুববেশি মাধ্যম বা সময় চা শ্রমিকদের হাতে নেই। একটু সময় পেলেই চা শ্রমিকরা বিশেষ করে মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে ঝুমুর নৃত্যে মেতে ওঠে। বংশ পরম্পপরায় তারা এ নৃত্য করে আসছে হাজার বছর ধরে।
একদিকে মাদল বাজছে আরেক দিকে গান গেয়ে বিশেষ ছন্দে একটি দল নাচছে। কখনও দ্রুত লয়ে বা কখনও ধীর লয়ে। আবার একটি বেদিকে কেন্দ্র করে দলটি তালে তালে ঘুরছে। এমন অদ্ভুদ মনমুগ্ধকর নাচের নাম ঝুমুর নাচ। মূলতঃ ঝুমুর গান প্রাচীন ধারার লোকসঙ্গীত। অনেক কাল আগে বিশেষ করে সাঁওতালদের মাঝে এটি প্রচলন ছিল। প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন জনপদেও এ নাচের কথা উল্লেখ রয়েছে। সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে ঝুমুরের সঙ্গে কীর্তন মিশে পরবর্তীকালে যাত্রার উদ্ভব ঘটেছে। চা বাগানে বসবাসরত চা শ্রমিকেরা প্রায় দেড়শ বছর আগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এদেশে আসে। তখনই তাদের সাথে করেই ঝুমুর নাচের অন্যন্য সংস্কৃতি নিয়ে আসে। চা শ্রমিকদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল নাচ। এরমধ্যে ঝুমুর নাচ, সাওঁতাল নাচ ও লাঠি নাচ অন্যতম। এসব নাচ কোন বিনোদনের জন্য আয়োজন করা হয় না। সাধারণত এসব নাচ বিভিন্ন পূজাকে উপলক্ষ্য করে হয়ে থাকে। তদ্রুপ ঝুমুর নাচও হয় করম পূজাকে উপলক্ষ্য করে। চা বাগানে বসবাসরত শ্রমিকেরা সম্পদ রক্ষার জন্য উপাসনার উদ্দেশ্যে এই পূজা করে থাকে। ঝুমুর নাচ ও গান একই সাথে হয়। নিজস্ব সম্পদ রক্ষার উদ্দেশ্যে ভাদ্র মাসের একাদশীর সাত দিন আগে থেকে ঝুমুর নাচ ও গানের মহড়া শুরু হয়। বংশ পরম্পরায় এই সংস্কৃতির তারা লালন ও চর্চা করে আসছে।
ঝুমুর নাচ প্রকৃত পক্ষে প্রার্থনা নির্ভর। সৃষ্টিকর্তার করুণা লাভই এর প্রধান লক্ষ্য। নাচ, গান ও বাদ্য সহযোগে ঝুমুর গাওয়া হলেও এতে গানের প্রাধান্য থাকে। বাদ্যযন্ত্রের মাঝে মাদল, ঢোল ও করতাল ব্যবহার করা হয়। গানের সুর উচু থেকে নিচে অবরোহণ করা হয়, যা ঝুমুরের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তালকে অগ্রাহ্য করে মাত্রা অনুসরণ করে সুর দেওয়া হয়। সম থেকে শুরু না করে ফাঁক থেকে গান শুরু করা হয়। ঝুমুর গানের কথাগুলো ভিন্ন হলেও সুরের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় না। ঝুমুর গানের কথাগুলো বাস্তবধর্মী এবং আসামীয় ভাষার প্রভাবযুক্ত। চা শ্রমিকদের দৈনন্দিন সুখ দুঃখ নিয়েই গানগুলো রচনা হয়। তবে মজার ব্যাপার হল এই গানগুলো কোথাও লিখে রাখা হয় না। মুখে মুখেই গানগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। ঝুমুর নাচ দলগত ভাবে পরিবেশন করা হয়। চা বাগানের নারী ও পুরুষেরা একত্রে শৃঙ্খলিত ভাবে পরিবেশন করে। এসময় একটি পবিত্র বেদিকে কেন্দ্র করে নাচের দল বৃত্তাকারে নেচে গেয়ে ঘুরে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল এই নাচ কাউকে হাতে ধরে শিখাতে হয় না বরং বংশগত ভাবেই এই নাচ চা শ্রমিকেরা ধারণ করে। অপূর্ব সুরলহরী সহকারে সমবেত ছন্দে শৃঙ্খলিত নৃত্যের ঝুমুর নাচ দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে পারে।