মানুষের গল্প বলা হয় উপন্যাসে। কেবল উঁচুতলার নয়, সাধারণ মানুষেরও। বহুমাত্রিক লেখক ও সাহিত্য সমালোচক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের ভাষায় ‘উপন্যাস মানুষের কাহিনী; সাধারণ মানুষের কাহিনী। চারপাশের বাস্তব মানুষের গল্প। আগে সাহিত্য রচিত হতো দেবতাদের নিয়ে, পরীদের নিয়ে, তাদের নিয়ে যারা অসাধারণ। মানুষের জীবনে গল্প আছে, এবং তা শোনার মতো, একথা মনে হয় নি মানুষের শতোশতো বছরে। আধুনিককালে এক সময় মানুষ আবিষ্কার করে যে তারই মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বেশি গল্প। তার ঘরে, তার মনে, তার চারদিকে, তাকে ঘিরে আছে গল্প, এবং তা শোনার মতো, বলার মতো। এ চেতনা থেকে সৃষ্টি হয় উপন্যাস আধুনিক কালে। মানুষ প্রথম উপন্যাস রচনা করতে এসে বেছে নেয় মানুষের মধ্যে যারা বড়ো, তাদের। আজকাল এ–বিষয়েও বদল ঘটেছে। আজ উপন্যাসে অতি সাধারণ মানুষের আধিপত্য। উপন্যাস সাধারণ মানুষের মহাকাব্য।’
পূর্বসূরীদের মতো সমকালের লেখকরাও চেষ্টা করছেন ‘মানুষের মহাকাব্য’ উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যে নিজের অবদান রাখতে। এবার বইমেলা উপলক্ষে এ সময়ের কথাসাহিত্যকদের প্রচুর উপন্যাস বেরিয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি মন জয় করে নিয়েছে পাঠকের।
নগরের সিআরবি শিরীষতলায় চলছে বইমেলা। মেলায় আসা পাঠকের মধ্যে প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা গেছে উপন্যাস ঘিরে। স্টলে স্টলে ঘুরে তারা খুঁজছেন পছন্দের ঔপন্যাসিকের উপন্যাস। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত কথাসহিত্যিকের উপন্যাস আছে তাদের পছন্দের শীর্ষে। এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত লেখকের উপন্যাসও আছে ক্রয়ের তালিকায়। এছাড়া চট্টগ্রামের কথাসাহিত্যিকদের লেখা উপন্যাস খুঁজতে দেখা গেছে অনেক পাঠককে। অবশ্য চট্টগ্রামের লেখকদের উপন্যাস খুব কম বেরিয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রকাশকের সঙ্গে আলাপকালেও বিষয়টির সত্যতা মিলেও।
নতুন বইয়ের খবর : ‘মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি নাম করা এক কলেজের প্রিন্সিপাল। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি কখনো। সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করেছেন। অন্যজন শিশির ঘোষ। থানার ওসি। তাঁর চাকরিজীবন কেটেছে চোর–ডাকাত–বাটপারদের সঙ্গে। আদর্শের দিক দিয়ে তিনি সৎ নন। সন্তানদের মানুষ করতে পারেননি ঠিকমতো। পেশা ও চিন্তার জায়গায় দুই প্রবীণের সামাজিক অবস্থান ভিন্ন, কিন্তু পরিণতি যেন এক! একটা সময়ে যে সমাজে এবং যে পরিবারে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, সেখানে আজ তাঁরা বাতিলের খাতায়। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ কেন নিরালম্ব হন? কেন হন উন্মূলিত? কোন প্রলোভনে মানুষ তার শৈশবকে ভোলে? অস্বীকার করে পিতা–মাতার বাৎসল্যকে? সেই প্রলোভনের নাম কি নারীদেহ? না অন্য কিছু?’ এবার প্রকাশিত হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস ‘একটু দাঁড়াও’–এ মিলবে এর উত্তর।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া দেবযানী সাহা। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর যৌন হেনস্তার অভিযোগ তোলে সে শিক্ষক শাহজাহানের বিরুদ্ধে। এই ছাত্রীর সঙ্গে অধ্যাপকের ঘনিষ্ঠতা পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শাহজাহানের স্ত্রী তাসলিমার সঙ্গে ছিল দেবযানীর গভীর সখ্য। কিন্তু শাহজাহানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের ঘটনায় তাঁর সাংসারিক ও সামাজিক জীবনে ঝড় ওঠে। ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে উত্তপ্ত।’ এ গল্প বিশ্বজিৎ চৌধুরীর এবার প্রকাশিত উপন্যাস ‘অভিযুক্ত’–এর। যে গল্পে ছাত্রীর অভিযোগের সূত্রে উঠে আসে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাজনীতি থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের নানা প্রসঙ্গ’। ‘ছাত্রনেতা শোয়েব কামরান, মেয়েদের হলের দাপুটে নেত্রী হোসনে আরার কথা যেমন এই উপন্যাসে উঠে এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে শাহজাহানের কলকাতায় পিএইচডি করতে যাওয়া সময়ের স্মৃতিও। রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রী মুর্শিদাবাদের মেয়ে নিগার সুলতানার সঙ্গে উত্তাল প্রেমের সেই দিনগুলোকে মনের গোপনে লুকিয়ে রাখেন শাহজাহান। এমন একজনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ কেন তোলা হলো? এর সত্যতা কতটুকু আর কতটুকুই–বা এর পেছনে অন্যের প্ররোচনা কাজ করেছে?’ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পাঠকে পৌঁছে যাবেন উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায়।
‘মেয়েটির শখ ছিল বুড়িগঙ্গায় নৌকায় ভাসতে ভাসতে ছবি আঁকবে। নদীটি তার জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়েটি যেতে পারছে না, নাকেমুখে নল নিয়ে সে হাসপাতালে যুদ্ধ করছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে এ যুদ্ধে জেতা সম্ভব না। তারপরও তার মধ্যবিত্ত বাবা লড়াই করে যাচ্ছেন তাকে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে তাঁর রাজকন্যা ছবি আঁকবে। বাবার আশা কি পূরণ হবে? মেয়েটি কি জিতবে এ লড়াইয়ে? আঁকতে পারবে সেই অপূর্ব ছবি?’ এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে এবার প্রকাশিত বাদল সৈয়দের উপন্যাস ‘জলে ডোবা সূর্যাস্ত’–এ।
হরিশংকর জলদাস, বিশ্বজিৎ চৌধুরী ও বাদল সৈয়দের উপন্যাসগুলোর বাইরে ‘চেনা এক জনপদের সেই অচেনা বাস্তবতার কাহিনি নিয়ে নিয়ে’ রচিত সুহান রিজওয়ানের ‘মুখোশের দিন বৃষ্টির রাত’ এবং জাহেদ মোতালেবের ‘জয়নালের ইতালিযাত্রা’ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
এছাড়া এবার বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হরিশংকর জলদাসের ‘উপেক্ষিতা সীতা’, আনিসুল হকের ‘কখনো আমার মাকে’, মোশতাক আহমদের ‘ঝিনুক নীরবে সহো’, মোস্তাক শরীফের ‘মির্জা গালিব’, আলভী আহমেদের ‘ঘোস্টরাইটার’, শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের ‘শেষ মৃত পাখি’, সুহান রিজওয়ানের ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’ ও ‘পদতলে চমকায় মাটি’, মাহবুব মুর্শেদের ‘বুনো ওল’, লুনা রুশদির ‘বই বাহিক’, আসিফ নজরুলের ‘আমি আবু বকর’, সুমন্ত আসলামের ‘অর্ধেক তুমি অর্ধেক বনলতা সেন’, তানজিনা হেসেনের ‘যদি পাখা পাই পাখি হয়ে যায়’, ইমরান খানের ‘বেসাতি ও বসতি’, মলয় রায়চৌধুরীর ‘ঘেরটোপ’, বিশ্বজিত পালের ‘মেঘলা আকাশ’, মাইনুল এইচ সিরাজীর ‘সেপ্টেম্বর বিভ্রম’, মহি মুহাম্মদের ‘আড়াইপাতা’ (যুগপূর্তি সংস্করণ), কাজী শরীফুল ইসলামের ‘আগন্তুক’, আহমেদ ইফতেখার রবির ‘সংশপ্তকের আলোকযাত্রা’, রেজানুর রহমানের ‘আবদুল মজিদ তার বউকে ভালোবাসে’, সাদাত হোসাইনের ‘আগুনডানা মেয়ে’ ও ‘তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে’, আফসানা বেগমের ‘প্রতিচ্ছায়া’, ইশতিয়াক আহমেদের কিশোর উপন্যাস ‘হাফপ্যান্ট’, পলাশ মাহবুবের কিশোর উপন্যাস ‘তিন দুরন্তর শিক্ষক’ এবং অঞ্জন নন্দীর ‘আপ শান্তিপুর লোকাল’।
এবার প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে কোনটি বেশি বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে বাতিঘর প্রকাশনের বিক্রয়কর্মী বাবলু আজাদীকে বলেন, ‘ঘোস্টরাইটার’ ও ‘মুখোশের দিন বৃষ্টির রাত’ বেশি চলছে। প্রথমা প্রকাশনের এক বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, ‘কখনো আমার মাকে’, ‘আমি আবু বকর’ ও ‘অভিযুক্ত’ বেশি বিক্রি হচ্ছে। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের আরমানুল হক বলেন, এবার আমাদের উপন্যাস কম বেরিয়েছে। সুহান রিজওয়ানের লেখা উপন্যাস বেশি চলছে।
চন্দ্রবিন্দুর প্রতিনিধি জুঁই আফরিন বলেন, ‘জয়নালের ইতালিযাত্রা’ ও মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস সমগ্র বেশি চলছে। অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনের তৌহিদুল ইসলাম নুহাশ বলেন, ‘আড়াইপাতা’ ও ‘আগন্তুক’ বেশি চলছে। তৃতীয় চোখের স্বত্বাধিকারী আলী প্রয়াস আজাদীকে বলেন, উপন্যাসের পাঠক বেশি। নতুনদের মধ্যে যারা উপন্যাস লিখেন তাদের পরিচিতরা বা যারা পাঠকমহলে পরিচিতি পেয়েছেন তাদের উপন্যাস বিক্রি হয়।
গতকাল ছিল মেলার ১০ দিন। মেলা চলবে আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত। মেলা প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
আবৃত্তি উৎসব : গতকাল বইমেলা মঞ্চের আয়োজন ছিল ‘আবৃত্তি উৎসব’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। কবি ওমর কায়সারের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী ডালিয়া আহমেদ, বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু ও সম্মিলিত আবৃত্তি জোট চট্টগ্রামের সভাপতি ফারুক তাহের। সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিশিল্পী মুজাহিদুল ইসলাম।