চলমান সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ নগরের রাস্তাঘাট ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়নে গত অর্থবছরে (২০২৪–২০২৫) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ব্যয় হয় ৩৯৫ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরটির প্রস্তাবিত বাজেটে চসিক প্রকল্পটির বিপরীতে ব্যয় বরাদ্দ রাখে ৫৫০ কোটি টাকা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, বরাদ্দ রাখার পরও চসিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির আওতায় প্রতিশ্রুত ব্যয় কেন করেনি? এর উত্তরে জানা গেছে, এডিপিভুক্ত প্রকল্পটি সম্পূর্ণ অনুদান নির্ভর। ফলে সরকার থেকে চসিক যে পরিমাণ বরাদ্দ পেয়েছে ততটুকুই খরচ করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল ঘোষিত চসিকের আগামী ২০২৫–২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রকল্পটির বিপরীতে ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয় ৬০০ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, এ ধরনের এডিপি ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নভুক্ত ৯টি প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয় ৯৪৪ কোটি টাকা। বিপরীতে প্রকল্পগুলোসহ থোক বরাদ্দ হিসেবে চসিক উন্নয়ন অনুদানের আশা করেছে ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা।
এ অবস্থায় বিমানবন্দর সড়কসহ নগরের রাস্তাঘাট ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পের উদাহারণ টেনে বলা যায়, প্রকল্পের বিপরীতে চসিক যে উন্নয়নের যে ছক এঁকেছে তার পুরোটাই নির্ভর করছে অনুদানের উপর। অর্থাৎ অনুদান না পেলে থমকে যাবে প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি বা নগর উন্নয়ন। গতকাল ঘোষিত চসিকের ২০২৫–২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এবং ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ২০২৪–২০২০৫ অর্থবছরে চসিক ৯টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রাখে ৯০৪ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর বিপরীতে অনুদান পেয়েছে ৫০৭ কোটি টাকা। ফলে এবার প্রস্তাবিত বাজেটে প্রল্পের বিপরীতে নগর উন্নয়নে ৯৪৪ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখলেও তা বাস্তবায়ন নির্ভর করবে অনুদান পাওয়ার উপর।
কোন প্রকল্পে কত বরাদ্দ : অনুদান নির্ভর প্রকল্পগুলোর মধ্যে বহদ্দারহাট বারইপাড়া হতে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকা, আধুনিক নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ২০ কোটি টাকা, সড়কবাতি স্থাপন প্রকল্পে ২ কোটি টাকা, বাস টার্মিনাল প্রকল্পে ১২ কোটি টাকা, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে লোকাল গভর্নমেন্ট কোভিড–১৯ রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রজেক্ট প্রকল্পের বিপরীতে ১০০ কোটি টাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে আধুনিক যান–যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকা এবং ২১ টি খাল খনন প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
অনুদান নির্ভরতা কাটাতে প্রয়োজন স্বর্নিভর হওয়া : এডিপি ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পগুলোর বাইরে নিজস্ব তহবিল থেকেও নগর উন্নয়নে খরচ করে চসিক। এ খাতে সড়ক বাতি, রাস্তা ও ফুটপাতের উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনসহ ২৩টি খাতে অর্থবছরে (২০২৪–২০২৫) চসিক ব্যয় করে মাত্র ৭৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অথচ চসিক একই অর্থবছরে নিজস্ব উৎস থেকে আয় করেছে এক হাজার ৮৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বিপুল অংকের রাজস্ব আয়ের বিপরীতে উন্নয়ন ব্যয় মাত্র ৭ শতাংশ।
এর কারণ হিসেবে, চসিকের রাজস্ব আয়ের সিংহভাগহ খরচ হয় সংস্থাটির পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে। গত অর্থবছরে এ খাতে খরচ হয় ৬৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। যা গত অর্থবছরের সশোধিত বাজেটের ৫২ শতাংশ। এ অবস্থায় নগর বিশ্লেষকরা মনে করেন, চসিককে আরো বেশি আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। স্বনির্ভর হলে উন্নয়ন অনুদান না পেলেও থামবে না নগর উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। এ বিষয়ে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন তার বাজেট বক্তব্যে বলেন, চসিককে ঋণমুক্ত স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি। উপযুক্ত উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আয় বহুগুণে বাড়বে এবং চসিক আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে।
পাইপলাইনে সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ১২ প্রকল্প : পাইপলাইনে রয়েছে এমন ১২টি প্রকল্পের কথা জানান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। ৩৫ হাজার ৫৫১ কোটি টাকার এসব প্রকল্পের কয়েকটির ডিপিপি (উন্নয়ন প্রস্তাবনা) প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে চসিক। কয়েকটির ডিপিপি প্রস্তুত করা হচ্ছে।
প্রকল্পগুলো হচ্ছে– ২০৩ কোটি টাকায় নগর ভবন নির্মাণ, ২৯৮ কোটি টাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আধুনিক যানযন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্প, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উন্মুক্ত স্থানসমূহ আধুনিকায়ন, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় উন্নয়ন ও সবুজায়ন প্রকল্প, ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় সাতটি রাস্তার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, ৫০ কোটি টাকায় কিচেন মার্কেট কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প, ৫০ কোটি টাকায় ওয়ার্ড কার্যালয় নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, ১ হাজার ৫০ কোটি টাকায় প্রাইমারি সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, ২ হাজার কোটি টাকায় ওশান অ্যামিউজমেন্ট পার্কনির্মাণ প্রকল্প, ৭০০ কোটি টাকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্প, ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প ও ২৫ হাজার কোটি টাকায় মনোরেল নির্মাণ প্রকল্প। এছাড়া আন্তঃজেলা বাস–ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানান মেয়র।
কমেছে বাজেট বাস্তবায়নের হার : গতকাল ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের সংশোধিত ১ হাজার ২২১ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বাজেটও ঘোষণা করেন মেয়র। অর্থবছরটিতে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ১ হাজার ৯৮১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নের হার ৬১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অথচ পূর্বের (২০২৩–২৪) অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। ওই হিসেবে কমেছে বাজেট বাস্তবায়নের হার।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ১ হাজার ৮৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন হয় ১ হাজার ৬৬১ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর আগে ২০২২–২৩ বছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৫৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।
দেনা শোধে সাফল্যের দাবি : মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের সময় কর্পোরেশনের দেনার পরিমাণ ছিল ৫৯৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ডিএসএল বাবদ বকেয়া ছিল ১৪৬ কোটি টাকা। ধারাবাহিক দেনা পরিশোধের মাধ্যমে বর্তমানে মোট দেনা ৪০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, উন্নয়ন সহায়তা বরাদ্দ খাতে ৬৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং বিশ্ব ব্যাংকের কোভিড–১৯ সহায়তা বাবদ প্রায় ৬০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। আয়কর বাবদ ৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, ভ্যাট বাবদ ৩৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আনুতোষিক ও ভবিষ্যত তহবিল বাবদ যথাক্রমে ১৯ কোটি ১৮ লাখ ও ২৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। প্রতি মাসে ৪০০ জনকে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে আনুতোষিক প্রদান অব্যাহত রয়েছে।