উন্নয়নের ‘গ্লোবাল রোল মডেল’ বাংলাদেশ

পিংকু দাশ | বুধবার , ২২ নভেম্বর, ২০২৩ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত। জিডিপি বৃদ্ধির হার দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বেশি। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশগড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ এখন অন্য সব দেশের জন্য উন্নয়নের ‘গ্লোবাল রোল মডেল’। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এবারের স্লোগান ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা’। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, ৪টি মূলস্তম্ভের ওপর স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি। স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে সাড়ে ১২ হাজার ডলার।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পর পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য বড় আনন্দের সংবাদ। এক অভাবনীয় কর্মযজ্ঞের শুভ সূচনা করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১১ নভেম্বর তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ আইকনিক রেলস্টেশনের পর্দা উন্মোচন করেন। ১৮ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত হয়েছে দোহাজারীকক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প। এর ফলে রেলওয়ে যুগে পদার্পণ করেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে এই রুটে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হবে। ভবিষ্যতে চট্টগ্রামকক্সবাজার রেললাইন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে।

উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পঞ্চগড় থেকে যেন কক্সবাজারে আসা যায়, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। একইভাবে রাজশাহী, সুন্দরবন থেকে যেন আসা যায়, সেটিও করতে হবে। কক্সবাজারবাসীকে অনুরোধ করব, তারা যেন আমাদের দেশের অন্য অঞ্চলগুলো ঘুরে দেখে আসে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ট্রান্সএশিয়ান নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চাই। আমরা আধুনিক রেল স্টেশন বানিয়েছি। আপনারা এটা যত্ন নিয়ে ব্যবহার করবেন। কোনো কিছু নষ্ট করবেন না।’ রেলসচিব হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কঙবাজারের সাথে শুধু ঢাকা নয়, পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গেও এই রেলপথ যুক্ত হবে।’ তাই শুধু ঢাকা নয় উত্তরাঞ্চল ও দেশের অন্যান্য অংশ থেকেও কঙবাজারে রেলপথে আসা যাবে। এতে করে যোগাযোগের নতুন পথ উন্মোচিত হবে।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সাথে কক্সবাজারের মানুষও স্বপ্ন দেখেছিল রেলের। ১৩৩ বছরের স্বপ্ন পূরণ হলো কক্সবাজারবাসীর। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হলো ঝিনুক আকৃতির আইকনিক রেলস্টেশন এবং ১০২ কিলোমিটার রেললাইনের। এই ১০২ কিলোমিটার রেললাইন প্রকল্পে নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।

আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮৯০ সালে বৃটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা করা হয় চট্টগ্রামকক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের (সাবেক বার্মা) আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের। তারপর ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালে চট্টগ্রামদোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা অনুসারে কঙবাজার পর্যন্ত বাকি অংশে রেলপথ তৈরি হয়নি। এরপর ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে দোহাজারীরামুকঙবাজার রেলপথ স্থাপনের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল তিনি এই রেলপথ নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশ্লেষকদের ভাষায় : ‘কঙবাজারে রেললাইন নির্মাণের জন্য বৃটিশ চেষ্টা করল, পারল না। পাকিস্তান চেষ্টা করল, পারল না। আর আমরা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর রেললাইন পেলাম। অবশেষে আমরা বাঙালিরা সেটা পারলাম।’

চট্টগ্রামকঙবাজার রেলপথের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। এই পথে আছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, ৪টি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু। কঙবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা এলাকায় ২৯ একর জমিতে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্টেশন। এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটকবান্ধব কেন্দ্র্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলা স্টেশন। যেখানে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা। চোখ জুড়ানো রেলস্টেশনটি ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য আকর্ষণীয় স্পটে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী ভিড় করছেন এই দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি দেখার জন্য। একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। রেল যোগাযোগ তার মধ্যে অন্যতম। দোহাজারীকঙবাজার রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে দেশে ৪৫ জেলায় যুক্ত হচ্ছে রেল। এর মাধ্যমে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কঙবাজারে নিরাপদে ভ্রমণ করা যাবে।

চট্টগ্রামকে ঘিরে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে একই দিনে (১১ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং এই সমুদ্র বন্দরের ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ কৃত্রিম নৌ চলাচল চ্যানেল। বর্তমান সরকারের উন্নয়নযজ্ঞে এটি আরেকটি মাইলফলক। এই বন্দর দেশের অর্থনীতিতে ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার অবদান রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এটি চালু হলে সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের খরচ ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমবে। বন্দরটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করবে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাতারবাড়ি বন্দরটি দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হবে। কারণ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আর পণ্যের জন্য সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার বন্দরে অপেক্ষা করতে হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পণ্য শিপমেন্ট পাঠাতে ৪৫ দিন সময় লাগে। বন্দরটি চালু হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে মাত্র ২৩ দিন লাগবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থার কারণে এখানকার গভীর সমুদ্র বন্দর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে। গভীর সমুদ্র চালু হলে বড় জাহাজ সরাসরি বিদেশি সমুদ্র বন্দরে যেতে পারবে এবং পণ্য লোডঅফলোড করা আরও সহজ ও সস্তা হবে এবং সময় সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশ শুধু নয় নেপাল, ভুটান ও ভারতও এই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এই ধরনের ব্যবহারে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে গভীর সমুদ্র বন্দরকে আরো কার্যকর করতে পারি।’

বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামবাসীর আরেকটি বড় স্বপ্ন পূরণ হলো, সুড়ঙ্গপথে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধনের পর টানেল যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। শিল্পোউদ্যোক্তাদের চোখ এখন আনোয়ারাকর্ণফুলীতে। এর মধ্যে জমি কিনে শিল্পকারখানা চালুর পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে অনেকেই। টানেলের সাথে বিমান বন্দরের দূরত্ব কমে আসায় বিদেশি বায়ররাও সহজে আসা যাওয়া করতে পারবে আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান ইপিজেডসহ অন্যান্য নামিদামি প্রতিষ্ঠানে। ঢাকাচট্টগ্রামকঙবাজার মহাসড়কে যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্থাপিত হল নব দিগন্ত। গতি পাবে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য। চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে গড়ে তোলার যে লক্ষ্য সরকারের ছিল তার একটি বড় পদক্ষেপের বাস্তবায়ন হলো, নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে আরও যেসব অবকাঠামো দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত, বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা তার মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু’, ‘পদ্মা সেতু’, ‘দ্রুতগতির উড়াল সড়ক’, ‘মেট্রোরেল’ অন্যতম। বাংলাদেশ আজ অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,

বোয়ালখালী হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনাসির হোসেন জীবন : মৃত্যুকেই যিনি আপন করে নিলেন
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে