উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু করা দরকার

শেখ বিবি কাউছার | বৃহস্পতিবার , ২৫ জুলাই, ২০২৪ at ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। সেটা হতে পারে জলবায়ু কিংবা প্রযুক্তিতে। নতুন নতুন প্রযুক্তি জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। বর্তমান বিশ্ব প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়েও মূল্যবান মনে করছে মানব সম্পদকে। কারণ তারা মনে করছে জনসংখ্যাকে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে তারাই প্রকৃতিকে সম্পদে রূপ দিতে সক্ষম হবে। তাই সেই মানুষকে সম্পদে রূপান্তর করার জন্য প্রয়োজন গবেষণামূলক বিষয়গুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করা। তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো কৃষি শিক্ষা। যদিওবা এটি মাধ্যমিকে আছে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে বিষয়টি একদম নেই বললেই চলে। হয়তো অল্প কিছু কলেজে ননমেজর বিষয় হিসেবে থাকতে পারে। নতুন প্রজন্মকে কৃষিমুখী করতে কৃষি শিক্ষা বিষয়টি পরিবর্তন করে ‘আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা’ শিক্ষা রাখা যেতে পারে। তাহলে তারা কৃষি সম্পর্কে জানতে ও গবেষণা করতে আগ্রহী হবে। বর্তমান মেধাবী শিক্ষার্থীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখে কিন্তু কজনই বা স্বপ্ন দেখে কৃষি গবেষক, কৃষি বিজ্ঞানী হওয়ার? হয়তো স্বপ্নটার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে আমরা ব্যর্থ। বাংলাদেশে বর্তমানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সংখ্যা শিক্ষার্থীদের তুলনায় অপ্রতুল।

আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, উন্নয়ন শব্দটা শিক্ষার সাথে ওতোপ্রতভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণা করে দেশের খাদ্য উৎপাদনে অনেক এগিয়ে গেছে। তার অন্যতম কারণ হলো তারা কৃষি শিক্ষাকে একাডেমিক পড়াশোনার সাথে যুক্ত করেছে সাথে হাতে কলমে শেখাতে পারছে। একটা সময় আমাদের দেশে হালের বলদ আর লাঙলজোয়ালই ছিল কৃষি কাজের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আসছে অভাবনীয় পরিবর্তন। আধুনিক কৃষিতে এখন ব্যবহার হচ্ছে বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রজননে সফটওয়্যার, অর্গানিক প্রযুক্তি, সেচে উন্নত সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। এমনকি কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট। আর এরমধ্যে কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। এমনকি বাদ পড়ছে না গবাদিপশু পালনেও। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে রোবটটিই কৃষকের ভূমিকা পালন করবে। আমাদের দেশের কৃষি এখনও প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিকাংশ দেশ প্রকৃতিকে বশ করে কৃষি উৎপাদন করছে। মহাকাশে স্থাপিত কৃত্রিম উপগ্রহ আর কম্পিউটারকে সমন্বয় করে বিজ্ঞানীরা গড়ে তুলেছে একটি অত্যাধুনিক কৃষি আবহাওয়া নেটওয়ার্ক। যার মাধ্যমে কৃষির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারছে।

আমাদের নতুন প্রজন্মকে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানাতে হবে। তাহলে তারা কৃষি কাজে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে লাঙলজোয়াল দেখার জন্য তাদেরকে যেতে হবে জাদুঘরে।

একবার ভেবে দেখুন তো, যদি পরিশ্রমী কৃষকের সাথে মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী কিংবা ভালো গবেষক যুক্ত করা যায়, সাথে সৎ ব্যবসায়ী তাহলে আমাদের দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! কবিগুরু তাইতো অনেক আগেই বলে গেছেন, ‘আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হবে।’

কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের জীবনবোধ ও রাষ্ট্রচিন্তার সাথে নিবিড় সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই তাঁর কবিতাগুলোর মধ্যে। তাঁর বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লাঙল’ এর একটি কবিতা হলো কৃষাণের গান– ‘ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল, আমরা মরতে আছি, ভালো করেই মরব এবার চল।।’ শুধু কবিতা নয়, তিনি গান, ছোট গল্পও লিখেছেন কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে।

আমাদের কৃষি ও অসহায় কৃষকদের জন্য শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অবদান রেখে গেছেন তা নতুন প্রজন্মকে জানানো প্রয়োজন। অবিভক্ত বাংলার কৃষক প্রজারা অত্যাচারী লোভী মহাজনদের হাতে যে নিপীড়িত ও নিগৃহীত হতো তা থেকে রক্ষা করার জন্য এবং কৃষক ও প্রজার কল্যাণে শেরে বাংলার নেতৃত্বে গঠিত হয় নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি (১৯২৭)। তিনি কৃষক সমিতি গঠন করেছিলেন দেশের নিঃস্ব ভূমিহীন কৃষকসমাজের স্বার্থকে সামনে রেখে। এমনকি তিনি যখন মুসলিম লীগের নেতা ঠিক তখনও মুসলিম লীগ অপেক্ষা কৃষকসমিতি নিয়েই বেশি চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন আর এটির পেছনেই দিতে লাগলেন সমস্ত সময় ও শক্তি। তিনি বলতেন, ‘মুসলিম লীগ যেমন ভারতীয় মুসলমানদের জন্য দরকার, কৃষক প্রজা সমিতি করা তেমনি বাঙালি মুসলমানদের জন্য দরকার।’

এরপর স্বাধীনতার পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি ও কৃষকরা ছিল অত্যন্ত অবহেলিত। কৃষি ও কৃষকদের প্রতি এই অবহেলা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলে। তাই তিনি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নের কথা বলতেন খুব জোরালোভাবে। এমনকি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তাঁর সক্রিয়তাই কৃষি উন্নয়ন, পাটের মূল্য, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর আইনগত কাঠামো দিয়ে প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন তিনি। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন বা কাঠামোগত উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে শুরু হয়। বাংলার ইতিহাসে এই যে কৃষি ও কৃষকের কথা আছে তা কী নতুন প্রজন্মকে জানাতে পারছি আমরা? যদি নতুন কারিকুলামে এ বিষয়ে আলোচনা থাকে তাহলে তারা কৃষি কাজ ও গবেষণার প্রতি আগ্রহী হবে।

আমাদের দেশে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন হচ্ছে ঠিক তেমনি দেশের মেধাবী বিজ্ঞানীরা কৃষিতে সাফল্যে দেখিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। আপনারা জেনে অবাক হবেন, ভৌগলিক দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নের ভাঙ্গারদিয়া গ্রামে নির্মিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু মানমন্দির’। এটি নির্মিত হলে বাংলাদেশের কৃষি চিত্র অনেকটাই পাল্টে যাবে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এখন পর্যন্ত ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মোট ১১৮টি উচ্চ ফলনশীল জাত, রোগ ও পোকা দমন, পানি সাশ্রয়ী যুগোপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ২০২২ সালে বিনা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা লবণসহিষ্ণু ধানের জিনোম সিকোয়েন্সিং উন্মোচন করেছিল, যা বাংলাদেশে প্রথম। বর্তমানে ভাসমান বেডের উপর সবজি ও মসলা চাষের আগ্রহ বাড়ছে এবং তা নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে। বাজারে দেশি পেয়ারার পাশাপাশি যে কাজীপেয়ারা দেখা যায় এটির উদ্ভাবক হলেন কৃষিবিজ্ঞানী কাজী এম বদরুদ্দোজা। তাঁর নামেই ‘কাজী পেয়ারা’ নামকরণ হয়। এদিকেপাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে যিনি বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি হলেন বিশ্বখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ, পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। বাংলাদেশের আরেকজন বড় বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান পাট থেকে তৈরি করেছেন পলিথিনের (পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি) বিকল্প সোনালী ব্যাগ। যা অল্প সময়ের মধ্যে মাটির সাথে মিশে যায়। পাটের পলিথিন ছাড়াও তিনি পাট থেকে জুটিন নামক টিনও তৈরি করেছেন।

সম্প্রতি খাদ্য সংকটময় বিশ্বে বাংলাদেশকে ১০০ বছর এগিয়ে দিয়েছেন যিনি তিনি হলেন জিন বিজ্ঞানী ড.আবেদ চৌধুরী। এই বিজ্ঞানী জমিতে একবার চারা রোপণ করে পাঁচবার ফলন দেয়া ‘পঞ্চব্রীহি ধান’এর উদ্ভাবক। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের সেরা সব বিজ্ঞানীদের সাথে গবেষণা করেছেন।

শিক্ষা কারিকুলাম তৈরির সাথে যাঁরা যুক্ত আছেন তাঁরা হয়তো উপরোক্ত বিষয়টি বিবেচনা করবেন। আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ হয়েও সে তুলনায় গবেষণাধর্মী কৃষি ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নেই। প্রতিটি বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আছে ঠিক তেমনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি ইনস্টিটিউটও করা এখন সময়ের দাবি। কৃষি সম্পর্কে এত কিছু তুলে ধরার পর তারপরও কি বলবেন কৃষি শিক্ষা ননমেজর বিষয় হিসেবে থাকবে একাডেমিক পড়াশোনায়? আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়টিকে উপেক্ষা করার সুযোগ আছে?

লেখক : প্রভাষক,

নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদ বুদ্ধিজীবী রায় সাহেব কামিনীকুমার ঘোষ
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম