দেশে অবাধে মরণনেশা ইয়াবা আসার সংবাদ গভীর উদ্বেগজনক। গত ১৭ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে এ বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছে, নাইট গার্ডের নেতৃত্বে ইয়াবা সিন্ডিকেট। সকলেই তাকে চিনত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের নাইট গার্ড হিসেবে। র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর সকলের চোখ ছানাবড়া। কারণ তাদের চেনাজানা নাইট গার্ড আনোয়ারা উপজেলার গহিরা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে রীতিমতো একটি ইয়াবা সিন্ডিকেট পরিচালিত হয়। তার সংকেতের ওপর ভিত্তি করেই স্পিডবোটের মাধ্যমে ইয়াবা নিয়ে সৈকতে আসেন মাদক ব্যবসায়ীরা। এরপর তাদের কাছ থেকে ইয়াবার চালানগুলো বুঝে নিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও উপজেলায় বিক্রি করেন।
মাদক হিসেবে কয়েক বছর আগে পর্যন্তও অভিভাবক থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্বেগের প্রধান কারণ ছিল ফেনসিডিল। এখন ইয়াবার ভয়ংকর ব্যাপকতা হার মানিয়েছে ফেনসিডিলসহ অন্য সব মাদককে। কিছু দিন আগেও যে ইয়াবা অভিজাত নেশা হিসেবে পরিচিত ছিল, তা এখন দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা এই বিধ্বংসী মাদক প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া জোরালো পদক্ষেপও কাজে আসেনি। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সারা দেশে ইয়াবার খুচরা বিক্রেতা বা বাহক পর্যায়ে অহরহ অনেকে ধরা পড়লেও সীমান্ত গলিয়ে আসা ‘মূল স্রোত’ বন্ধের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাঁরা বলেন, কোনো জিনিস সহজলভ্য হলে তার বিস্তার ঘটে দ্রুত। ইয়াবার ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। ইয়াবার সহজলভ্যতা রোধে আইনরক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক কেনাবেচা ও পাচারে সহায়তা করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও মাদক পাচারের সঙ্গে প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানদের বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থানের কথা সর্বজনবিদিত। তবে তা কতটা কার্যকর হচ্ছে, এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ইয়াবা সমস্যাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ইয়াবাসহ অন্যান্য অবৈধ ও ক্ষতিকর মাদক দ্রব্যের পাচার ও ব্যবহার বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করলেও এ সমস্যা সমাধানের নৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান সঠিক নয় বলে তাঁরা মনে করেন। তাঁদের মতামত হলো, ‘বিষয়টিকে এখন পর্যন্ত শুধু আইন-শৃঙ্খলা বা চোরাচালানগত সমস্যা বলে মনে করা হয়। এক শ্রেণির নীতিনির্ধারক মনে করেন, সীমান্তরক্ষী ও আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনীর ব্যর্থতা, পেশাগত দুর্বলতা, অদক্ষতা ও অসততার জন্যই ইয়াবার এতটা প্রসার ঘটছে। তাই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা উন্নয়ন কিংবা অসততা দূরীকরণের কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষপাতি। যেমন, সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সংখ্যা বাড়ানো, পুলিশ ও বিজিবির কঙবাজার এলাকায় রদবদল ইত্যাদি হয়েছে। এতে যে সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায়নি, তা নয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে অন্যান্য উপাদানগুলো অভিন্ন ও সমান সক্রিয় থাকলে শীঘ্রই অবস্থা আগের মতো হবে। অধিকন্তু দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবার চাহিদা তথা ব্যবহার অভিন্ন থাকলে ইয়াবা ভিন্ন পথে দেশে ঢুকবে। ভিন্ন দেশ দিয়ে ঢুকবে এবং ভিন্ন নাম দিয়ে ঢুকবে।’ তাঁরা বলেন, ইয়াবাসহ ক্ষতিকর মাদকের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সমস্যাটিকে শুধু আইন-শৃঙ্খলাজনিত নয়, সামাজিক বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাই এর সমাধানও সামাজিক প্রক্রিয়ায় হতে হবে।
সামাজিকভাবে ইয়াবার পাচার প্রতিরোধ করা গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনি অনেকটা সহযোগিতা লাভ করতে পারে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি আওতায় আনতে হবে। পাচারকারীরা যতই ক্ষমতাধর হোক আইনি শক্তির কাছে এক সময় তাদের মাথা নত করতে হবে। সরকারকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হবে। যে কোনো মূল্যে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল করতে হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীরা যেমন পাচারের কৌশল পাল্টায়, তেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচক্ষণ কর্মকর্তাদেরও কৌশলী হতে হবে।