যে উন্নত গুণাবলি মানুষকে সুশোভিত করে, প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে, তার অন্যতম একটি হচ্ছে আমানত রক্ষা। এ গুণটি দুনিয়াতে যেমন মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ, তেমনি আখেরাতেও তার নাজাতের অন্যতম অসিলা। আমানত অর্থ গচ্ছিত রাখা। আমানতের বিপরীত অর্থ খিয়ানত করা। কারো কোনো সম্পদ গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলে। যে আমানতের হিফাজত করে তাকে আল-আমিন বলা হয়। হজরত মুহাম্মদ সা: আমানতকারীদের সরদার।
আমানত শব্দটি আরবি আমনুন মূল ধাতু থেকে নির্গত হয়েছে। যার অর্থ ভরসা করা, আস্থা রাখা। অর্থাৎ কাউকে বিশ্বাস করে তার কাছে কোনো কিছু গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলে। আমানত রক্ষা করা অপরিহার্য দায়িত্ব।
আমানত শব্দটি ব্যাপক এবং বহুমুখী একটি শব্দ। আমরা অনেকেই এটিকে খুব সীমিত আকারে বুঝে থাকি ; বিষয়টি তা নয়, শুধু গচ্ছিত আমানত রাখার সময় ভেবেচিন্তে রাখা: আমানত হলো সাধারণত কারো কাছে কোনো হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখা। এখানে একটি বিষয় ভালোভাবে লক্ষ রাখতে হবে যে, তা যেন অবৈধভাবে উপার্জিত না হয়। যেমন, চুরি, ডাকাতি, ছিনিয়ে আনা সম্পদ আমানত রাখলে তা আমানত হিসেবে হবে না ; বরং তার মূল মালিকের খোঁজ পাওয়ার সাথে সাথেই তাকে অবগত করতে হবে এবং তার অর্থ-সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি আমানত গ্রহীতা সব জেনেও মূল মালিকের কাছে বিষটি গোপন রাখে তবে চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই করে যে গোনাহের কাজ করল, যার কাছে গচ্ছিত সেও সত্যকে গোপন রেখে ততটুকুই গোনাহের কাজ করল। রাসুল সা: ইরশাদ করেন, মানুষ যখন কোনো অন্যায়কারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, অতিসত্বর আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন (তিরমিজি ও আবু দাউদ)।
কোন কোন বস্তু আমানত হিসেবে হবে : আমানত শুধু ধনসম্পদ নয়, বরং ব্যাপকার্থে যেকোনো জিনিস গচ্ছিত রাখাকেই আমানত বলে। ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, সরকারি-বেসরকারি দাফতরিক কার্যক্রম, শিক্ষকতা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্ব, মজুরি ইত্যাদি সবই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ মানুষের সুস্থ বিবেক, হাত-পা, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ঠোঁট ইত্যাদি প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই অপরের কাছে আমানতস্বরূপ। এগুলোর ব্যবহার প্রসঙ্গে বিচার দিবসে জিজ্ঞেস করা হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, চোখের খিয়ানত এবং অন্তর যা গোপন রাখে তা তিনি জানেন (সূরা আল মুমিন-১৯)।
অনুরূপভাবে, শরিয়তের ফরজ কাজ, সতীত্বের হিফাজত, ফরজ গোসল, নামাজ, জাকাত, রোজা, হজ ইত্যাদিও আমানত। এ কারণে বেশির ভাগ মনীষী বলেন, দ্বীনের যাবতীয় কর্তব্য আমানতের অন্তর্ভুক্ত।
আমানতের খেয়ানত : আমানতের খিয়ানত না করার মধ্যে অন্যতম আরেকটি বিষয় হলো, অন্যের কোনো গোপন কথা কারো কাছে আমানত রাখলে, তা প্রকাশ করে খিয়ানত না করা। তবে গোপন বিষয়টি প্রকাশের মাঝে যদি ওই ব্যক্তির ইহ ও পরকালীন সফলতা থাকে, তাহলে তার কল্যাণ কামনায় তা প্রকাশ করা ও তাকে সদুপদেশ দেয়া। রাসুল সা: ইরশাদ করেন, একজন মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের হক হলো একজন পরামর্শ চাইলে অপরজন পরামর্শ দেবে এবং তার মঙ্গল কামনা করবে (আল আদাবুল মুফরাদ-৯২৫)।
বর্ণিত আছে, হজরত আলী রা: এর খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর একদা রাতের বেলা বাতির আলোতে রাষ্ট্রীয় কাজ করছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি বিশেষ প্রয়োজনে তার কাছে এলেন। আলী রা: বাতি নিভিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দিলেন, এতক্ষণ আমি সরকারি কাজ করছিলাম। তাই সরকারি তেল ব্যবহার করেছি। এখন তো ব্যক্তিগত কাজ করছি। সরকারি বাতি ব্যবহার করা আমানতের খিয়ানত হবে।
দায়দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে যোগ্য, কর্মদক্ষ এবং আমানতদার ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা উচিত। অযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া কিয়ামতের লক্ষণ। এ মর্মে নবী সা: ইরশাদ করেছেন, যখন আমানত নষ্ট করা হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষায় থাকো। জিজ্ঞেস করা হলো,আমানত কীভাবে নষ্ট করা হবে? তিনি বললেন, অযোগ্য ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব অর্পণ করা আমানত নষ্ট-করনের শামিল। আর এমনটি করা হলে বুঝবে কিয়ামত সন্নিকটে (বুখারি-৫৯)
একটি দেশ বা জাতির উন্নতি বা অবনতির পেছনে আমানতদারির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আমানতদারিতা এমন এক মহৎ গুণ যার ওপর জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। দেশ বা জাতির জন্য বিভিন্ন পদে দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি সে তার কাছে গচ্ছিত রাখা গোপন তথ্য অন্যের কাছে পাচার করে দেয় তবে সে দেশ বা জাতিকে সহজেই কাবু করা সম্ভব হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ তার প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও (সূরা আন নিসা-৫৮)।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসুল (সা.)ও তোমাদের ওপর ন্যস্ত আমানতের খিয়ানত করো না। অথচ তোমরা এর গুরুত্ব জানো (সূরা আনফাল-২৭)।
আমানতের খিয়ানত করা কবিরা গুনাহ ও মুনাফিকের আলামত, আর আমানত রক্ষা করা ঈমানদারের আলামত। হাদিসে এসেছে রাসূল সা: বলেছেন,যার মধ্যে আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই, আর যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না তার দ্বীন নেই।
মহানবী সা: বলেছেন, মুমিনের মধ্যে আর যত দোষই থাক খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যাচার থাকতে পারে না। হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন তোমরা খিয়ানত করো না কেননা খিয়ানত কতই না শাস্তি ও তিরস্কারযোগ্য অপরাধ (আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
মহানবী সা: আরো বলেন, তোমার সাথে চারটি জিনিস থাকলে পৃথিবীর সব হারিয়ে ফেললেও তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না ১. আমানতের হিফাজত ২. সত্যবাদিতা ৩. উত্তম চরিত্র ও ৪. পবিত্র রিজিক হালাল হওয়া। মুমিনের কাছে সর্বাপেক্ষা উত্তম সম্পদ হলো আমানতদারিতা। তাই মুমিন আমানতদারিতা রক্ষা করতে সদা সচেষ্ট থাকে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।