লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী তাদের প্রধান নেতা সাঈদ হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। এক বিবৃতিতে গোষ্ঠীটি বলেছে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। সেইসঙ্গে গাজা ও ফিলিস্তিনের সমর্থনে এবং লেবানন ও এর জনগণের সুরক্ষায়ও তারা লড়াই করে যাবে।
হিজবুল্লাহ নাসরাল্লাহর মৃত্যুর খবর জানানোর আগে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, গত শুক্রবার বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলীতে তাদের বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন। এরপর নাসরাল্লাহর মৃত্যুর ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গেই হিজবুল্লাহর আল মানার টিভি কোরানের বাণী সম্প্রচার শুরু করেছে। হিজবুল্লাহ তার মৃত্যুর খবর জানালেও দলের পরবর্তী নেতা কে হবেন তা বিবৃতিতে জানায়নি। নাসারাল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জবাব কীভাবে দেওয়া হবে তাও গোষ্ঠীটি জানায়নি। খবর বিডিনিউজের।
কে এই হাসান নাসরাল্লাহ : হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর খবর হিজবুল্লাহ নিশ্চিত করার পরই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)-এর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি টিভিতে এক ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে নাসরাল্লাহকে ইসরায়েলের এ যাবৎকালের ‘সবচেয়ে বড় শত্রুদের একজন’ বলেই অভিহিত করেছেন তিনি।
৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাসরাল্লাহই ছিলেন হিজবুল্লাহর প্রাণস্পন্দন। মিত্র ইরানের সহযোগিতায় তিনি হিজবুল্লাহকে একটি শক্তিশালী লড়াকু দল হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। যার পরিণতিতে ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে দুইদশক–ব্যাপী দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে বাধ্য হয়েছিল ইসরায়েল। ২০০৬ সালের লড়াইয়ে ইসরায়েলকে থমকে দিতে হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই নাসরাল্লাহ। সম্প্রতি কয়েক বছরেও নাসরাল্লাহই ছিলেন ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় একক শত্রু। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রায় এক বছর ধরে লেবানন সীমান্তে পাল্টাপাল্টি হামলার পর সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে হিজবুল্লাহর ওপর চড়াও হয় ইসরায়েল। হিজবুল্লাহকে পরাস্ত করতে সর্বশক্তি দিয়ে লড়ার অঙ্গীকার করে তারা। এক্ষেত্রে ইসরায়েল কান দেয়নি মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শেও। লেবাননে হিজবুল্লাহর আস্তানাগুলোকে নিশানা করে লাগাতার বিমান হামলা চালাতে চালাতে অবশেষে তারা শেষ করল তাদের ঘোর একজন শত্রুকে।
লেবাননের শিয়া মুসলিম সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম পরিচিত এক মুখ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ইসরায়েলের হামলায় নিহত হতে পারেন এমন আশঙ্কার কারণে গত কয়েক বছর ধরেই নাসরাল্লাহকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। হাসান নাসরল্লাহর ছিলেন ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা এক ‘ছায়া’ ব্যক্তিত্ব। হিজবুল্লাহকে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বছরের পর বছর অন্তরালে থাকলেও নাসরুল্লাহ তার সমর্থকদের কাছে ছিলেন সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। নাসরাল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়েছে। ইরাক ও ইয়েমেনের মিলিশিয়াদের পেছনেও আছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইরানের কাছ থেকে পাওয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটের বড় ধরনের ভান্ডার আছে হিজবুল্লাহর।
জন্ম ও ইতিবৃত্ত : ১৯৬০ সালে বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় বুর্জ হামুদ এলাকায় জন্ম হাসান নাসরাল্লাহর। তার বাবার নাম আবদুল করিম। তিনি ছিলেন একজন সবজি বিক্রেতা। তার নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন নাসরাল্লাহ। ১৯৭৫ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি শিয়া ‘আমল আন্দোলনে’ যোগ দেন। কিছুদিন ইরাকের নাজাফে শিয়া সেমিনারিতে কাটানোর পর সেখান থেকে লেবাননে ফিরে আবার আমলে যোগ দিয়েছিলেন নাসরাল্লাহ। তবে ১৯৮২ সালে আমল আন্দোলন ভাগ হয়ে গেলে, তিনিও দলছুট হয়ে যান। এর কিছুদিন পরেই ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালায়। হিজবুল্লাহর সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে দলে নাসরুল্লাহর অবস্থান মজবুত হয়। ওপরের পদে আসীন হতে থাকেন তিনি। হিজবুল্লাহর একজন যোদ্ধা থেকে নাসরাল্লাহ বালবেক এলাকার পরিচালক হন, পরে তিনি পুরো বেকা ভ্যালির দায়িত্ব পান এবং এরপর সংগঠনের বৈরুত শাখার দায়িত্ব নেন বলে জানিয়েছিলেন।
মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরাল্লাহ। এর আগে ইসরায়েলের এক হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হয়েছিলেন তার পূর্বসূরি আব্বাস আল–মুসাবি। হিজবুল্লাহ প্রধানের দায়িত্ব নিয়েই মুসাবি হত্যার বদলা নেওয়া ছিল হাসান নাসরাল্লাহর প্রথম কাজ। সে সময় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। হামলায় এক বালিকা নিহত হয়। এছাড়াও, তুরস্কে ইসরায়েলের দূতাবাসে গাড়িবোমা হামলায় এক ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলায় ২৯ জন নিহত হয়।
ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান নাসরাল্লাহ। সেই লড়াইয়ের অবসান হয়েছিল ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলি সেনারা সরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে সেই লড়াইয়ে নাসরাল্লাহর ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়েছিল। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন তার বড় ছেলে হাদি।
ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবানন থেকে পিছু হটার পর নাসরাল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরবদের প্রথম বিজয়ের ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে তিনি অঙ্গীকার করেন, ইসরায়েলকে দমন না করা পর্যন্ত তার দল অস্ত্র পরিহার করবে না। সেবা ফার্মস এলাকাসহ দখল করা লেবাননি সব ভূখণ্ড ইসরায়েলকে ছাড়তে হবে বলে হুঙ্কার দেন তিনি।
কিছুদিন আগে লেবাননে পরপর দুইদিন হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহার করা হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ৩৯ জন নিহত হয় এবং আরও হাজারো মানুষ আহত হয়। এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছিলেন হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরাল্লাহ। তিনি বলেছিলেন ‘ইসরায়েল সীমা লঙ্ঘন করেছে।’ তবে ওই হামলা তার দলের জন্য এক ‘নজিরবিহীন ধাক্কা’ বলেও তিনি স্বীকার করেছিলেন।
কে হচ্ছেন হিজবুল্লাহর নতুন নেতা : হিজবুল্লাহর কেবল নাসরাল্লাহই নন বরং বলতে গেলে প্রায় সব শীর্ষ নেতাই ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছে। দলের নেতৃত্ব এখন কে দেবেন সে ব্যাপারে হিজবুল্লাহ এখনও বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট কিছু জানায়নি। তবে নাসরাল্লাহর কাজিন হাশেম সাফিয়েদ্দিন হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব দিতে পারেন, শোনা যাচ্ছে এমন কথা।
নির্বাহী পরিষদের প্রধান হিসাবে সাফিয়েদ্দিন হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক বিষয়গুলো দেখভাল করেন। হিজবুল্লাহর সামরিক অভিযান পরিচালনাকারী জিহাদ কাউন্সিলেরও সদস্য তিনি। সম্পর্কে হাসান নাসরাল্লাহর কাজিন হাসেম সাফিয়েদ্দিন তার মতোই একজন ধর্মীয় নেতা। তিনিও মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বংশধরের প্রতীক হিসাবে কালো পাগড়ি পরেন। ২০১৭ সালে তাকে সন্ত্রাসীর তকমা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত জুনে এক হিজবুল্লাহ কমান্ডার নিহত হওয়ার পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বদলা নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। সাফিয়েদ্দিন তখন বলেছিলেন, শত্রুকে কান্না ও বিলাপের জন্য প্রস্তুত হতে বল। জনসম্মুখে হাসেম সাফিয়েদ্দিনের বিবৃতিতে প্রায়ই হিজবুল্লাহর সামরিক অবস্থান ও ফিলিস্তিনিদের জন্য সংহতির বিষয়টির প্রতিফলন ঘটে। নাসরাল্লাহর সঙ্গে সা িয়েদ্দিনের পারিবারিক সম্পর্ক, দৈহিক গড়নে নাসরাল্লাহর সঙ্গে সাদৃশ্য এবং ধর্মীয় মর্যাদাও একরকম হওয়ায় সবদিক থেকেই হিজবুল্লাহর নেতা হওয়া তার জন্য অনুকূল।