বুকটা চিরে আছড়ে পড়ে কোন এক অচিন দেশে–সিনাওয়ার, তুমি তো পৃথিবীর দুঃসাহসিক এক অপ্রতিরোধ্য মুজাহিদ, তোমার রক্তের বদলা নিতে লাখো সিনাওয়ার তৈরি হচ্ছে–রক্তখেকো নেতানিয়াহু, তৈরি হও বুলেট বোমায় ঝাঁঝরা হবে তোমার বুক– ফিনিক্স পাখির মতন জেগে উঠবে হামাসের বীরেরা– বোবা কান্না শরীরময়, চোখের তৃতীয় রেটিনায় এক জোড়া সাগরের কান্না– ভিজে যায় গাজার জমিন– ডুকরে কেঁদে উঠি, অব্যক্ত ভালবাসা তোমার জন্য সিনাওয়ার– তুমি রঙ্গিন পাখি হয়ে ওড়ে ওড়ে ভাসছো জান্নাতময়……। বলছিলাম ফিলিস্তিনের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারের কথা–যিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করেছেন কাফির শক্তির বিরুদ্ধে–যেভাবে যুগে যুগে ইহুদি–খ্রিস্টান কাফের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দারা। নিজ মাতৃভূমি রক্ষার দৃপ্ত শপথ নিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন ফিলিস্তিনের অসংখ্য মর্দে মুজাহিদ। হামাস–এক অসীম সাহসী স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী, যারা দীর্ঘদিন ধরে জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন অসীম সাহস নিয়ে। নিজের থাকার জায়গাটুকু যাদেরকে উপহার দিয়ে নিজেই উদ্বাস্তু আজ– সেই তারাই আজ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। উদ্বাস্তু ইহুদিদের দয়াপরবশ হয়ে জায়গা দিয়ে সেই নিরীহ ফিলিস্তিনবাসী আজ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাদের জায়গা জমি সব দখল করে ইহুদি বসতি স্থাপন করেছে জায়নবাদীরা। গত ৭ অক্টোবর এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ইহুদিদের গালে চপেটাঘাত করেছে হামাস মুক্তিযোদ্ধারা। যেভাবে আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনেছিল একাত্তরে। আবার দ্বিতীয় স্বাধীনতা এনেছে গত ৫ আগস্ট। দেড় হাজারের মতন ছাত্র–জনতার রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার পতন হয়েছে। আজ সেই অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব সবার। তেমনি করে ফিলিস্তিনের মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধারা মার খেতে খেতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তখন তারা আবার জেগে উঠেছে ইহুদিবাদীদের অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। একজন শীর্ষ নেতা হয়ে ইয়াহিয়া সিনাওয়ার সারা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন–মুসলিমরা কখনো ডরায় না, তারা বীরের মতন লড়ে যায়–তারা শাহাদাতের পেয়ালা পান করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। আর সেটি সিনাওয়ার চোখে আঙ্গুল দিয়ে ঘুমন্ত বিশ্ব বিবেককে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। আজ মুসলিম বিশ্ব নিশ্চুপ। বর্বর ইসরায়েল বাহিনী গাজা ছাড়াও লেবানন, সিরিয়াতেও তান্ডব চালাচ্ছে বিশ্ব মোড়লখ্যাত সন্ত্রাসী আমেরিকার মদদে। রক্তের বন্যায় যেন গাজার জমিন ভিজে যায়। সবুজ প্রান্তর যেন লাল বর্ণ হয়ে উঁকি দেয় আকাশের বুকে। সিনাওয়ার–তুমি সারা বিশ্বের ঘুমন্ত জনতাকে জাগিয়ে দিয়েছো–জিহাদের প্রচন্ড স্পৃহা যেন জেগে উঠেছে পৃথিবীময়। একজন হাফেজে কোরআন সিনাওয়ার। ২৩টি বছর ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি। এরই মধ্যে আল্লাহর কোরআনকে তিনি হৃদয়ের মাঝে স্থান করে নিয়েছেন। পুরো কোরআন মুখস্ত করে রেখেছেন হৃদয়ের তল্লাটে। সংসার জীবন যেন ভাল করে কাটাতে পারেননি সিনাওয়ারের। ৫০ বছর বয়সে পবিত্র উমরাহ পালনকালে পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়। নিজ বাচ্চাগুলোকে জনসম্মুখে নিয়ে আসতেন নির্ভয়ে। এদেরকেও আল্লাহর পথে জিহাদ করার উপযোগী করে তুলেছিলেন। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সিনাওয়ার গাজাবাসীর স্বাধীনতার রক্ষার লড়াইয়ে শেষ মুহূর্ত অবধি যুদ্ধে লড়েছেন ইহুদী জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে। জায়নবাদী সেনারা বরাবরের মতনই বোমাবর্ষন করছিল হামাস যোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করার অজুহাতে। সেরকম এক বিধ্বস্ত ভবনে অবস্থান করছিলেন এই অপ্রতিরোধ্য মুজাহিদ। তাদের অবস্থান টের পেয়ে সিনাওয়ার ও তাঁর সঙ্গী অপর দুই হামাস যোদ্ধা প্রাণপণ যুদ্ধ করেছেন জায়নবাদী কাফের সৈন্যদের সাথে কিন্তু না মহান আল্লাহতায়ালার সিদ্ধান্তই যেন চূড়ান্ত। যুদ্ধ করতে করতে তাঁর অপর সঙ্গীদ্বয় হামাস যোদ্ধা আল্লাহর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছেন। বোমার আঘাতে সিনাওয়ারের এক হাত উড়ে গেছে। এরপরেও তিনি দমে যাননি–ক্ষত–বিক্ষত শরীর নিয়ে তিনি পাল্টা গ্রেনেড ছুঁড়েছেন জায়নবাদী সেনাদের দিকে। পরবর্তীতে ড্রোন দিয়ে শনাক্ত করে তাঁর অবস্থান নিশ্চিত করে পুরো ভবনটি বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে বর্বর ইহুদি সেনারা। শেষ মূহুর্তে হাতের লাঠি দিয়ে তাঁর দিকে এগুতে থাকা ড্রোনের দিকে নিক্ষেপ করেছিলেন। বিশ্ববাসীর এক অবিসংবাদিত মুজাহিদ হিসাবে জানান দিয়ে গেছেন এই হামাস বীর। একজন হামাস প্রধান হয়েও সাধারণ যোদ্ধার মতন লড়াই করে গেছেন আজীবন। বর্বর যুদ্ধবাজ নেতা নেতানিয়াহুর রক্তচক্ষুকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। তাঁকে গাজা ছাড়ার আহবান করেছিল নেতানিয়াহু প্রশাসন কিন্তু কি এক অব্যক্ত ভালবাসার কাছে যেন তিনি হেরে গিয়েছিলেন সেদিন। নিরীহ গাজাবাসীকে রেখে তিনি অবকাশ যাপন করার সেই দুর্লভ সুযোগটাকে যেন লাথি মেরে নিক্ষেপ করেছিলেন। তিনি পারতেন আরাম–আয়েশে বিদেশে দিন কাটাতে কিন্তু সেই সুযোগটাকে তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি অসহায় গাজাবাসীর সুখে–দুঃখে থাকার প্রত্যয়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ হামাস যোদ্ধাদের মতই দিনযাপন করছিলেন গাজায় অনির্দিষ্ট ঠিকানায়। আর একেই বলে বীর মুজাহিদ–যিনি মৃত্যুকে নিজের জীবনের চাইতে বেশি ভালবাসতেন–তিনি জানতেন তাঁর শাহাদাতের তামান্না অবধারিত। তবুও গাজার মাটির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছিলেন। এই ধরনের অপ্রতিরোধ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঘটনা আসলেই পৃথিবীতে বিরল। এর আগেও ইরানে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে শহীদ করেছে বর্বর ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বাহিনী। হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসারাল্লাহকে শহীদ করেছে বৈরুতের একটি ভবনের নিচে অবস্থিত বাংকারে। আমেরিকার তৈরি বাংকার ব্লাষ্টার বোমায় ক্ষত–বিক্ষত করেছে হাসান নাসারাল্লাহর শরীর। এভাবে ইহুদী জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে একে একে শহীদ হয়েছেন হামাস–হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতারা। যেভাবে আমার রাসূল (সাঃ) নেতৃত্বে অসীম সাহসী সাহাবীগণ কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন ১৪০০ বছর আগেই। আজ দীর্ঘ ১৪০০ বছর পর তারই ধারাবাহিকতায় গাজা–লেবাননের সবুজ প্রান্তর যেন রক্ত লাল হয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য আল্লাহর সেই আয়াতটিই যথেষ্ট, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে তোমরা মৃত বল না, বরং তারা হচ্ছে জীবিত কিন্তু তোমরা কোন চৈতন্যই রাখ না’–সূরা বাকারা–১৫৪। সূরা আলে ইমরানের অন্য একটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে তোমরা কোন অবস্থাতেই মৃত মনে কর না। বরং তারা জীবিত–তাদের মালিকের কাছ থেকে তাদের রেজেক দেওয়া হচ্ছে’–সূরা ইমরান–১৬৯। এভাবে যুগে যুগে হাজারো সিনাওয়ার তৈরি হবে এবং আল্লাহর পথে লড়াই করতে করতে শহীদ হবে–এটাই তো মর্মান্তিক সত্য। আর সেই পথেই এগুচ্ছে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়া হামাসের যোদ্ধারা। ২২ হাজার বর্গকিলোমিটারের একটি দেশ এবং ৭০ লক্ষ ইহুদি বসতির একটি দেশ–সারা বিশ্বের ১৩০ কোটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র তাদের বিশ্ব প্রযুক্তির অসম্ভব নৈপুণ্যতার কারণে। কিন্তু আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী সেই বীর মুজাহিদরা এখনো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত গাজা–লেবাননের প্রান্তরে প্রান্তরে। বলা হয় ৭ অক্টোবরের সেই হামলার পরিকল্পনা ও মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সিনাওয়ার। ইহুদিরা যদি মনে করে থাকে একজন সিনাওয়ার কিংবা একজন ইসমাইল হানিয়াকে শেষ করে দিতে পারলেই স্বাধীনতা যুদ্ধ খতম হয়ে যাবে, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। ইতিহাস সাক্ষী–হামাসের যত শীর্ষ নেতাকেই শহীদ করা হয়েছে–এর পরবর্তীতে তারা যেন কয়েকগুণ শক্তিতে আবার বলীয়ান হয়ে জেগে উঠেছে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর যুদ্ধে মেতে উঠেছে। সেই ইহুদিরা হামাস কিংবা হিজবুল্লাহকে শেষ করেও শেষ করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ এবং সেটাই আল্লাহতায়ালার হেকমত, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়–ভীতি, ক্ষুধা–অনাহার, জান–মাল ও ফসলাদির ক্ষতি সাধন করে (তোমাদের পরীক্ষা করা হবে, যারা ধৈর্যের সাথে এর মোকাবেলা করে) তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দান কর’–সূরা বাকারা–১৫৫। সিনাওয়ার–জেগে থাকবে সারা বিশ্বের মুসলিমদের হৃদয়ের অতলান্ত গভীরে।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব; সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল