সম্রাট ফিরোজ শাহ্ তুঘলকের রাজত্বকালে একদল শাহী কর্মচারী লাহোর থেকে দিল্লী যাওয়ার পথে পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দের জঙ্গল অতিক্রম করেছিলেন। তৎমধ্যে একজন কামেল ব্যক্তি অন্তরদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন গভীর জঙ্গল থেকে একটি উজ্জ্বল নূর বিকিরিত হচ্ছে। দিল্লী পৌঁছেই তিনি সম্রাটের মুর্শিদ সৈয়দ জালালুদ্দীন বুখারী (রহ.) কে এই অলৌকিক ঘটনা অবহিত করলেন। পীর ছাহেব বিস্তারিত শুনে সম্রাটকে দ্বিতীয় সহস্রের ইসলামের মুজাদ্দেদ আগমনের শুসংবাদ প্রদান করে বললেন, ‘জমানার মুজাদ্দেদ ও ইমাম যাঁর ঐশী নূরে সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হবে, যিনি পূর্ববর্তী সমস্ত অলী এবং কুতুবগণের কালামাত লাভে ধন্য হবেন, তিনি এই সিরহিন্দেই জন্ম লাভ করবেন।’ যুগপৎ চমকিত ও বিস্মিত সম্রাট পীর ছাহেবের কথা শুনে পূণ্য লাভের মানসে সিরহিনেদর জঙ্গল কেটে সেখানে একটি শাহী দূর্গ নির্মাণে মনোনিবেশ করলেন। এদিকে পীর ছাহেব তদীয় খলিফা হজরত ইমাম রফিউদ্দীন (রহ.)কে সিরহিন্দের কুতুব মনোনীত করে বললেন, ‘মনে রেখো সেই মুজাদ্দেদ এর জন্ম তোমার বংশেই হবে’।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) এর সুযোগ্য বংশধর হজরত ইমাম রফিউদ্দীন (রহ.) এর আওলাদ হজরত মখদুদ আবদুল অজাাদ সিরহিন্দি (রহ.) এর ঔরসে হিজরী ৯৭১ সনের ১৪ই শাওয়াল শুক্রবার এই উপমহাদেশে নক্শবন্দিয়া তরীকার মহান বুজর্গ হজরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দ শরীফে জন্ম লাভ করেন। যে সমস্ত মহা পুরুষ কালের প্রবাহে নিজেদের অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের দ্বারা, জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক কর্মকান্ডের ফলে, সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার এবং বেদআত সমূহের মূল উৎপাটন করে মানুষের কল্যাণ সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের মধ্যে হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানীর নাম প্রণিধানযোগ্য।
হিজরী ১০১০ সালের ১০ই রবিউল আউয়াল একদিন মুরাকাবার হালতে হজরত দেখতে পেলেন রসুলে আকদস্ (দ.) তথায় তশরিফ এনে একখানা মহামূল্যবান পোষাক তাঁকে পরিয়ে বললেন, মুজাদ্দেদ আল্ফেসানীর পোষাক এটাই। একদা হজরতের লাহের অবস্থানকালীন সময়ে প্রখ্যাত আলেমে দীন মাওলানা জামাল উদ্দীন তিল্ভী ও মাওলানা আবদুল হাকিম শিয়ালকোটি হজরতের কাছে মুরিদ হয়ে যান এবং তাঁর কর্মের অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে মুজাদ্দেদ আল্ফেসানী সম্মানে ভূষিত করেন।
হজরত তৃতীয়বার দিল্লী আগমন করলে মুর্শিদ কেবল হজরত খাজা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, ঐ সময় হজরত শায়খ আহমদ বহুল প্রশংসিত কাইউমিয়ত এর স্তরে উপনীত হয়েছেন, তাই তিনি অত্যন্ত নম্রতার সাথে মুরিদের ন্যায় তাঁর সামনে বসে রইলেন। বেলায়েত এবং নবুয়তের মধ্যখানে কাইউমিয়তের স্তর। কাইউম হচ্ছে মহান সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামিনের এমন একজন সম্মানিত খলিফা যার আধ্যাত্মিক প্রতিবিম্বের পরিধির অন্তর্ভুক্ত সমস্ত কুতুব। আওতাদরা তাঁর কামালিয়ত এর বেষ্টনীভুক্ত। কাইউমের স্তরে পৌঁছার দরুন হজরতের উপর যে সমস্ত মারিফাত প্রকাশ লাভ করেছে সেগুলো চার ভাগে ভাগ করা যায়।
ক. মহা গ্রন্থ পবিত্র কোরআন শরীফের মুকাত্তাআত ও আয়াতে মুতাশাবেহাতের ব্যাখ্যা যা তিনি কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেননি।
খ. ঐ সমস্ত মারিফাত যা তিনি তদীয় কামালিয়ত প্রাপ্ত পুত্রগণ ব্যতীত অন্য কারো কাছে প্রকাশ করেননি।
গ. ঐ সমস্ত গুপ্ত বিষয় যা তিনি তদীয় মুরিদগণের নিকট অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে বর্ণনা করেছেন।
ঘ. ঐ সমস্ত মারিফাত যা তিনি সূফীগণের শিক্ষা লাভের নিমিত্তে পুস্তাকাকারে বা মকতুবের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
একদিন জোহর নামাজান্তে হজরত শায়খ আহমদ (রহ.) পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শুনছিলেন, এমতাবস্থায় অন্তদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলেন সরওয়ারে কায়েনাত হজরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (দ.) তশরীফ এনে একটি মহা মূল্যবান তাজ তাঁকে পরিয়ে দিয়ে কাইউমিয়ত পদ লাভের জন্যে মোবারকবাদ জানালেন।
কাদেরীয়া তরীকার প্রবর্তক হজরত গাউছ সাকলাইন মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) একদা কোন জঙ্গলে মুরাকাবায় রত ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন হঠাৎ একটি নূর আকাশ থেকে বিদ্যুৎ বেগে প্রকাশ হয়ে সমস্ত জাহান আলোকিত করে ফেলে। ঠিক এমতাবস্থায় তিনি এল্হাম প্রাপ্ত হলেন, এখন থেকে পাঁচশত বৎসর পরে যখন বিশ্বে শিরক ও বিদআত ছড়িয়ে পড়বে তখন একজন বুজর্গ অলী বিদআত সমূহ নিশ্চিহ্ন করে দুনিয়ার বুকে দীনে মুহাম্মদীকে পুন প্রতিষ্ঠিত করবেন। এ ঘটনার পর তিনি স্বীয় জুব্বা মোবারক কামালাতে পরিপূর্ণ করে নিজ পুত্র সৈয়দ তাজুদ্দীন আবদুর রাজ্জাক কে সোপর্দ করে আদেশ করেন, যখন ঐ বুজর্গের প্রকাশ হবে তখন যেন এই জুব্বাখানা উপহার স্বরূপ তাঁকে প্রদান করা হয়।
একদা মুজাদ্দেদ (রহ.) মুরিদ পরিবেষ্টিত হয়ে হালকার মধ্যে মুরাকাবায় মগ্ন ছিলেন এমন সময় কাদেরীয়া তরীকার বরেণ্য সূফী সাধক হজরত কামাল কায়্থলী (রহ.) এর পৌত্র হজরত শাহ্ সেকান্দর তশরীফ এনে একটি জুব্বা মোবারক হজরতের কাঁধে স্থাপন করেন। মুরাকাবা সমাপন করে হজরত উনার সাথে কোলাকুলি করতঃ অত্যন্ত আদবের সাথে পার্শ্বে বসালেন। অতপর হজরত শাহ্ সেকান্দর প্রদত্ত বড় পীর ছাহেবের জুব্বাখানি পরিধান করে খাস কামরায় প্রবেশ করলেন। তখনি অন্তর্দৃষ্টিতে অবলোক করলেন যে, হজরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এবং শাহ্ কামাল কায়থলী (রহ.) আপনাপন খলিফাদের নিয়ে তশরীফ এনে হজরতকে রূহানী জগতের অফুরন্ত নেয়ামতে মালামাল করে দেন।
হজরত তদীয় মুরিদদের জন্যে অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে শিক্ষা লাভ রতে পারে এমন একটি তরীকা গঠনে সচেষ্ট হন। অতঃপর নক্শবন্দীয়া তরীকার অঙ্গসৌষ্ঠবকে আরো মহিমামন্ডিত করে এক নতুন তরীকার প্রচলন করেন, যা বিশ্বব্যাপী মুজাদ্দেদীয়া তরীকা নামে খ্যাতি লাভ করে। বস্তুত এল্ম মারিফাতের সকল তরীকা আরব এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত কিন্তু এটাই একটি মাত্র তরীকা যা ভারত থেকে প্রকাশ লাভ করে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত এ যাবত কালের সমস্ত তরীকার নির্যাস নিয়ে মুজাদ্দেদীয়া তরীকা গঠিত হয়েছে বলে বিভিন্ন তরীকার মশায়খগণের ফয়ুজাত ও কালামাত সমূহ এ তরীকায় প্রবিষ্ট করা হয়েছে।
হজরত অনেকদিন যাবৎ হজ্বব্রত পালনের জন্যে ব্যাকুল ছিলেন। দেশের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং অন্যান্য কারণে তিনি এতদিন হজ্বে যেতে পারেননি। তাই হজ্বের সময় ঘনিয়ে এলে হজরত অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং মনের শান্তির খোঁজে তিনি মুরাকাবায় রত হলেন। বিস্ময়ের সাথে হজরত লক্ষ্য করলেন পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্ট বস্তু তাঁর দিকে নত হয়ে ঝুঁকে আছে। এল্হাম হলো, ‘আপনি পবিত্র হজ্ব পালনের জন্যে ব্যাকুল ছিলেন, তাই কাবাকে আমি আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি’। হজরত ব্যাকুল চিত্তে লক্ষ্য করলেন পবিত্র কাবা শরীফ তাঁর পাশেই হাজির। তাই সমস্ত কিছু কাবার দিকে রুজু হয়ে আছে। অতপর তিনি পবিত্র বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে ঐ স্থানটুকু লাঠি দিয়ে চিহ্নিত করে রাখলেন। পরবর্তীকালে ঐ স্থানটি মর্যাদাসহকারে পাকা রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে জেয়ারতকারীদের সুবিধার জন্যে।
আল্লাহপাক পৃথিবীর প্রত্যেক এলাকায় প্রত্যেক জাতির জন্যে নবী প্রেরণ করেছেন। প্রাচীন ভারতবর্ষেও নবীদের আবির্ভাব হয়েছিল। যদিও তাঁদের অনুসারীদের সংখ্যা ছিল নগন্য। এ সম্পর্কে হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.) বলেন, ‘আমি কাশফের মাধ্যমে জানতে পারি ভারতবর্ষে অনেক নবীর আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁদের কবর থেকে নূর বিকশিত হচ্ছে’। পরে তিনি সিরহিন্দের অনতিদূরে ‘বরাস’ নামক স্থানে চল্লিশজন নবীর মাজার সনাক্ত করে দেন। মাজারগুলো একটি উঁচু টিলার উপর অবস্থিত। পরবর্তীতে যুগ বরেণ্য আলেমগণ তথায় গিয়ে হজরতের বক্তব্যের স্বীকৃতি দেন। বর্তমানে স্থানটি মুসলমানদের জিয়ারতের স্থান হিসেবে বিবেচিত।
একদিন হজরত মুরাকাবায় হালতে নিজের দোষ-ত্রুটির দিকে খেয়াল করে অত্যধিক বিনয় ও নম্রতা সহকারে কান্নাকাটি করছিলেন, এমন সময় ইলহাম হলো, ‘আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত লোখ আপনার ওছিলা গ্রহণ করে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে তাঁদেরকেও ক্ষমা করলাম। তাঁরা আপনার সিলসিলাভুক্ত হোক অথবা সিলসিলা বহির্ভূত হোক’।
হজরতের রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মুকতবাত শরীফ, মাবদা ও মাআত, মাআরিফে লাদুন্নিয়া, মুকাশিফাতে আয়নিয়া, ইস্বাতুন নবুয়ত এবং তাহলিলিয়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হজরতের কঠোর কঠিন আন্দোলনের কারণেই মহাপরাক্রমশালী আকবরের দীন-ই-ইলাহীর কবর রচনা হয়েছিল এবং নেশাগ্রস্থ সম্রাট জাহাঙ্গীরের তওবা নসীব হয়েছিলো। এরপর পরই ধার্মিক শাহজাহান এবং বুজর্গ আরওঙ্গজেবের আবির্ভাব হয়ে ভারতবর্ষে ইসলামী শাসন কায়েম হয়েছিলো।
হজরত শায়খ আহমদ ফারুকী মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.) ৬৩ বৎসর বয়সে হিজরী ১০৩৪ সনে ২৭শে সফর এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে আল্লাহ্পাকের দরবারে উপনীত হন। পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দ শরীফে তার রওজা শরীফ বিদ্যমান। হজরতের সাত পুত্র এবং তিন কন্যা ছিলেন। তাঁর পাঁচ হাজার খলিফা এবং অসংখ্য অনুসারীদের দ্বারা ইত্তেবায়ে সুন্নাহর আন্দোলন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। হজরতের তৃতীয় পুত্র কাইউমে ছানী খাজা মুহাম্মদ মাসুম (রহ.) ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আওলিয়া এবং নক্শবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকার মহান কান্ডারী। প্রতিবৎসর ২৭শে সফর হজরতের ওরশ শরীফ সিরহিন্দ শরীফে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কবি ও সাহিত্যিক