ইন্টারনেট: ব্যবহার, অপব্যবহার, অতিব্যবহার ও আসক্তি

মোহাম্মদ আফজাল হোসেন | রবিবার , ১৩ মার্চ, ২০২২ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ


ইন্টারনেটের প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল ১৯০৭ সালে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনীতে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর। ইন্টারনেটের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে ইন্টারনেট আজ সকলের দোরগোড়ায়। এর বদৌলতে আজ মানুষ অনেক অসাধ্যকে সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। এটি আজ বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। মানুষের জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পাদনের ক্ষেত্রে এটা অপরিসীম ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাই ইন্টারনেটের যৌক্তিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা সমাজ ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি। পাশাপাশি এর অযৌক্তিক ব্যবহার মানবজীবনে বহুবিধ ক্ষতিসাধন বয়ে আনে। প্রয়োজনীয় বিষয়ের বাইরে যেমন অপ্রয়োজনীয় ফেইসবুকিং, অপ্রয়োজনীয় শপিং, ব্রাউজিং, গেইমিং, গ্যামবিলিং, পর্নোগ্রাফি দেখা ইত্যাদিতে ইন্টারনেটের ব্যবহারকে অপব্যবহার বলা হয়। অর্থাৎ ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে কাজ করা হয় যা ব্যক্তির মন ও শরীর নিতে পারে না সেটাকেই অপব্যবহার বলা হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায় এই অপব্যবহার শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক, পূর্ণবয়স্ক, মধ্যবয়স্ক, বয়োবৃদ্ধ – এক কথায় সবাই করছে। শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা বন্ধু সিলেকশন, অ্যাফেয়ার রিলেশন, চ্যাটিং, গেইমিং, পর্নোগ্রাফী ইত্যাদি এগুলিতে অপব্যবহার বেশি দেখা যায়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, পর্নোগ্রাফী, ব্যক্তিত্বের সমস্যা ইত্যাদিতে বেশি আসক্তি দেখা যায়। ইন্টারনেট ব্যবহার মানবজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে ইন্টারনেট ব্যবহার হল অতিব্যবহার। ইন্টারনেটের অতিব্যবহার হল যার ব্যবহার প্রয়োজন নাই অর্থাৎ যা না হলেও চলে। যার ব্যবহার ছাড়া আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মগুলো ভালোভাবে চালিয়ে নিতে পারি তা হল অতিব্যবহার। ইন্টারনেটের ব্যবহার হতে হবে পরিশীলিত ও যৌক্তিক। এর যথাযথ ব্যবহার করতে না পারলে আমরা উন্নতির দিক থেকে পিছিয়ে যাবো। এতে দেশ পিছিয়ে যাবে, জাতি হিসাবে আমরা পিছিয়ে থাকবো। এর ব্যবহার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। ইন্টারনেট আসক্তির জন্য ব্যক্তি কত সময় ধরে ব্যবহার করল সেটার চেয়ে কি ব্যবহার করল সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন কেউ যদি কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনে বা অন্য যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ইন্টারনেট দীর্ঘসময় ব্যবহার করে তার মধ্যে আসক্তি তৈরি হয়না কারণ সেটা মস্তিস্কে ডোপামিন সিক্রেশন করে না। কিন্তু যে বিষয়গুলোর কারণে মস্তিষ্কে ডোপামিন সিক্রেশন বেশি হয় সেগুলোতে বেশি আসক্তি তৈরি হয়। যেমন ভিডিও গেমস, পর্নোগ্রাফী ইত্যাদি। ইন্টারনেট আসক্তির মনোবৈজ্ঞানিক কারণ হিসাবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো তুলে ধরা যায়- কোন বিষয়, অবস্থা, ঘটনা, বস্তু, ব্যক্তির সাথে সংযোগ তৈরি হওয়ার ফলে আসক্তির বিষয়টি চলতে থাকে, যে বিষয়গুলো আমাদের আনন্দ দেয় সেগুলো ইতিবাচক বলবর্ধক এর মাধ্যমে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, ব্যক্তি যখন হতাশা, বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, একঘেঁয়েমিতে থাকে তখন এগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আনন্দদায়ক বিষয় খোঁজে। আর আনন্দের উৎস হিসাবে ব্যক্তি ইন্টারনেটের খারাপ ওয়েবসাইট খুঁজে নিতে পারে- এটা নেতিবাচক বলবর্ধক হিসাবে কাজ করে, ব্যক্তি যখন কোন একটা বিষয় দেখে, শুনে অথবা অন্য কাউকে দেখে তখন তার ভালোলাগা থেকে ব্যক্তির মধ্যে প্রত্যাশা জেগে উঠতে পারে, অন্যের ভালোলাগা দেখে নিজের ভালোলাগা শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও আসক্তি আসতে পারে। ইন্টারনেট আসক্তির কালো থাবা সমাজের সর্বত্রই বিরাজমান। এর ফলে শিশু-কিশোররা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি বয়স্করাও এর ভয়াবহ প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। শিশু-কিশোররা ভিডিও গেমস্‌, ফেইসবুকিং, চ্যাটিং সহ নানাবিধ বিষয়ে সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করছে। যার ফলে তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে তাদের আচার-আচরণে এবং লেখাপড়ায় যেমন অমনোযোগিতা, কাজে অনীহা, রাত জাগা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য। ইন্টারনেট আসক্তির প্রভাবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কে অবনতি, দাম্পত্য সম্পর্কে জটিলতা, পরকীয়া, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ইত্যাদি দেখা যায়। ইন্টারনেট আসক্তির কারণে আরও যেসব ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – সামাজিক দক্ষতা হ্রাস পাওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা কমে যাওয়া, সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি, ভালো বন্ধু-বানন্ধবের সংখ্যা কমে যাওয়া, সামাজিক জীবন বাধাগ্রস্ত হওয়া, পেশাগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, সাইবার ক্রাইমে জড়িয়ে পড়া, বিপদে পড়া, জীবনের স্বাভাবিক রুটিন নষ্ট হয়ে যাওযা, শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়া ইত্যাদি। ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে- প্রথমত ব্যক্তিকে স্বীকার করতে হবে যে সে আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চায়, সাধারণত: সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেটের অপব্যবহারকে আসক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এক্ষেত্রে ধাপে ধাপে আসক্তির মাত্রা কমানো যেতে পারে যেমন পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন সময় কমিয়ে আনা যেতে পারে, প্রতিবার সময় কমানোর সাথে সাথে নিজেকে পুরস্কৃত করা, এই সময়ে যদি মানসিক অবস্থা বেশি খারাপ হয় যেমন- মেজাজ খিটখিটে হওয়া, খারাপ লাগা, হতাশা, বিষণ্নতা, রাগান্বিত হওয়া ইত্যাদি তাহলে মনকে অন্য দিকে সরিয়ে নেয়া যেমন-নাটক, মুভি দেখা, গান শোনা, খেলা দেখা, ছবি আঁকা অথবা এমন কোনো কাজ করা যাতে মন ভালো থাকে, যার যার ধর্মানুযায়ী ধর্মীয় বিধিনিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলা, আসক্তির মাত্রা মারাত্মক আকার ধারণ করলে মনোবৈজ্ঞানিক সেবা গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানী, সাইকোথেরাপিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট প্রভৃতি বিশেষজ্ঞগণ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারেন, যেহেতু এই আসক্তি আমাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন করে তাই এই আসক্তির দিকে না গিয়ে আমরা যদি বিভিন্ন ধরণের সামাজিক দক্ষতা অর্জন করতে পারি এবং নানা ধরণের গঠনমূলক কাজে সময় ব্যয় করতে পারি তাহলে সেটা যেমন ব্যক্তির আত্মোন্নয়নে সহায়ক হবে তেমনি এর মাধ্যমে আমরা পরিবার ও সমাজের কল্যাণেও অবদান রাখতে সক্ষম হব। এভাবে ইন্টারনেটের অশুভ প্রভাব থেকে সমাজ তথা রাষ্ট্রকে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এব্যাপারে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, সচেতন সমাজ, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আইন রক্ষাকারী সংস্থা, সরকার তথা সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার ও আসক্তির বিরুদ্ধে সরকারিভাবে আইন প্রণয়ন করে এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে অমর আমাদের আব্বা এডভোকেট বদিউল আলম
পরবর্তী নিবন্ধ‘৭ মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা’