হোয়াইট হাউজ ছেড়ে যাওয়ার চার বছর পর ফের অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে পুরো বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এখন একজনই–তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে একে সবচেয়ে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন বলছেন কেউ কেউ।
গত মঙ্গলবার কোটি কোটি আমেরিকানের ভোটে ফের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প। অথচ চার বছর আগে এই ভোটাররাই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ট্রাম্প ক্ষমতা না ছাড়তে চাইলেও বাধ্য হয়েছিলেন হোয়াইট হাউজ ছাড়তে। এবার ফের তাকেই বরণ করে নিল যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা। আট বছর আগে যেবার প্রথম নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন, বিশ্বের খুব কম লোকই সেবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের পরিবর্তে তাকে নিয়ে বাজি ধরেছিল। কিন্তু ‘রাজনৈতিক ভূমিকম্পের’ বছর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ওই সময়ে ট্রাম্প ভূমিকম্পের মতোই নতুন যুগের সূচনা করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু ২০২০ সালে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেও প্রত্যাখ্যানের নিদারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর নির্বাচনের ফল মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন তিনি। এরপর নির্বাচনের ফল পাল্টে হোয়াইট হাউজে থেকে যাওয়ার চেষ্টায় এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছিলেন যেগুলো নিয়ে আজও তদন্ত চলছে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন ক্যাপিটলে ঘটা প্রাণঘাতী হামলা তিনি উস্কে দিয়েছিলেন, এমন অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটলে হামলার ঘটনা চিহ্নিত হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কুখ্যাত এক অধ্যায় হিসেবে। মনে হচ্ছিল, ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হয়ত সেখানেই শেষ হয়ে গেল। অচ্ছুত মানুষ হিসেবে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি ছেড়েছিলেন তিনি। কিন্তু চার বছর পর বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তনে আবারও ভোটের মঞ্চে আবির্ভূত হন তিনি। আবারও হোয়াইট হাউজের দখল নিতে মরিয়া লড়াইয়ে নামেন। আর পুরো নির্বাচনি প্রচারের সময়টিতে তিনি অনবরত উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে গেছেন। নিচু মানের রসিকতা করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের হুমকি ধামকি দিয়ে গেছেন। তারপরও কোনো কিছুই তার জয় আটকাতে পারেনি। এবার সবদিক থেকেই পরিপূর্ণ জয় পেয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালে ইলেকটোরাল কলেজে জয় পেলেও পপুলার ভোটে হেরেছিলেন, এবার ইলেকটোরাল–পপুলার উভয় ক্ষেত্রে এগিয়ে থেকেই জয় পেয়েছেন। ৭৮ বছর বয়সেও তার শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন। এই প্রত্যাবর্তন স্বপ্নের মতো হলেও কলঙ্ক তার পিঁছু ছাড়েনি। গুরুতর অপরাধের দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রথম প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়ে আরেক ইতিহাস তৈরি করতে যাচ্ছেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই চলে। সর্বশেষ প্রাপ্ত ফলে ট্রাম্প জিতে নিয়েছেন ২৯৪টি ইলেকটোরাল ভোট। আর হ্যারিস পেয়েছেন ২২৩ ভোট। লালে লাল রিপাবলিকান শিবির অবশ্য উৎসবে মেতে উঠেছিল আগেই। ২৬৬ ভোট নিশ্চিত হওয়ার পরপরই মঙ্গলবার রাতে ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে ওয়াচ পার্টির মঞ্চে হাজির হন ট্রাম্প। সমর্থকদের হর্ষধ্বনির মধ্যে ‘নজিরবিহীন ম্যান্ডেট’ দেওয়ায় আমেরিকার জনগণকে ধন্যবাদ জানান তিনি। ট্রাম্পের এই জয়ের মধ্য দিয়ে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় চেষ্টায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল যুক্তরাষ্ট্রে। তার আগে এই রেকর্ড ছিল কেবল গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের। ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হেরে গিয়ে চার বছর পর ফের তিনি জয়ী হয়েছিলেন ১৮৯২ সালে। ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প নানা নিরিখেই দেশটিতে ইতিহাস গড়লেন। তবে নিউ ইয়র্কের এই ধনকুবেরকে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়ে বিশ্বকে আরো একবার হতবাক করল আমেরিকা।
এবারের নির্বাচনে জাতীয় জনমত জরিপগুলোতে জনসমর্থনে হ্যারিস দ্রুত এগিয়ে যান, কিন্তু নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আসা সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্পের জনসমর্থনও বাড়তে থাকে। নির্বাচনের আগে জনসমর্থনের বিচারে দুই প্রার্থী প্রায় টাই অবস্থায় ছিলেন। তাদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে সবগুলো জরিপে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে পর ভোট গণনার ফল ট্রাম্পের পক্ষে আসতে বেশি সময় নেয়নি। মধ্যরাতের পর পুরোপুরি জয় হাতে আসার আগেই বিজয়ী ভাষণ দিয়ে দেন তিনি। তার সমর্থকরাও তাদের নেতার ফের প্রত্যাবর্তনে আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায়। সব বাধা পেরিয়ে অবশেষ ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউজের দখল ফিরে পাচ্ছেন। আগামী ২০২৫ এর ২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক শপথ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউজে ফিরবেন তিনি।
প্রতিনিধি পরিষদেও এগিয়ে : যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেটেরও দখল নিল ট্রাম্পের দল। নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজেন্টিটিভসেও রিপাবলিকানরা এগিয়ে রয়েছে।
২০২০ সাল থেকে ১০০ আসনবিশিষ্ট সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। চার জন নির্দল সিনেটরের সমর্থনে ৫১টি আসন নিয়ে এত দিন কমলার দলের দখলে ছিল সিনেটের নিয়ন্ত্রণ। অন্য দিকে, ট্রাম্পের দলের ছিল ৪৯টি আসন। কিন্তু মাত্র দুই আসনের ব্যবধান মুছে ফেললেন রিপাবলিকানরা। রিপাবলিকান পার্টি এরইমধ্যে ৫২টি আসনে জয় নিশ্চিত করেছে। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গেই সিনেটের ৩৪টি আসনে নির্বাচন হয়।
এত দিন হাউস অফ রিপ্রেজেন্টিটভসে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল রিপাবলিকানরা। প্রাথমিক গণনায় ইঙ্গিত, এবারেও সেখানে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে চলেছে তারা। হাউসের ৪৩৫ আসনের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৯৮টিতে জয়ী হয়েছে ট্রাম্পের দল। অন্য দিকে, ১৮০টিতে জয় পেয়েছে কমলার ডেমোক্র্যাট দল। হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে অবশ্যই ২১৮টি আসন পেতে হবে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে প্রার্থীই জিতুন না কেন, নতুন কোনও আইন পাশ করাতে গেলে এই দুটি কক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে এ ক্ষেত্রে সিনেটের গুরুত্ব খানিকটা হলেও বেশি। বিভিন্ন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পাশাপাশি প্রেসিডেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে জয়ী প্রার্থীদের নিয়োগপত্র সুপ্রিম কোর্ট পেশ করে সিনেটই। তাই হাউস ও সিনেটের ভোট সাধারণ নির্বাচনের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই চার বছর পরে সিনেটের দখল নিয়ে রিপাবলিকানরা অনেকটা স্বস্তিতে রইলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
আমেরিকার সংসদের নিম্নকক্ষে প্রতিটি আসনে দুই বছর অন্তর ভোট হয়। এত দিন ট্রাম্পের দলের হাতে ছিল ২২০টি আসন। কমলার দলের দখলে ২১২টি। তিনটি আসন শূন্য। সিনেটের ভোট প্রক্রিয়া হাউসের থেকে কিছুটা আলাদা। এখানে এক বার ভোটে জিতলে ছয় বছরের মেয়াদ থাকে। সেনেটের মোট আসনসংখ্যা ১০০টি। আমেরিকার প্রতিটি প্রদেশে দুজন করে সিনেটর নিযুক্ত থাকেন। সেই হিসেবে মোট ৫০টি প্রদেশে ১০০টি আসনের সবগুলিতে অবশ্য একসঙ্গে ভোট হয় না। প্রতি দু’বছর অন্তর এক তৃতীয়াংশ আসনে ভোট হয়।
হাতির পিঠে হোয়াইট হাউসে : ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা প্রথম বলেন ১৯৮৭ সালে, তখন গণমাধ্যম এটাকে তার প্রচারণার চমক ছাড়া আন্তরিক কোনো উদ্যোগ বলে মনে করেনি। ২০০৮ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ‘বার্থার’ আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখপাত্রে পরিণত হন ট্রাম্প। ওই আন্দোলনে ওবামার জন্মস্থান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন তোলা হয়। ত্যক্ত বিরক্ত ওবামা এক পর্যায়ে তার জন্মের সনদ প্রকাশ করেন, সেখানে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে তার জন্ম। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেমে চাপের মুখে আগের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ান ট্রাম্প। ওবামার জন্ম যে যুক্তরাষ্ট্রেই, এক বিবৃতিতে তিনি তা মেনে নেন। ২০১৫ সালের জুনে ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হতে চেয়ে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন দৌড়ে শামিল হন। রিপাবলিকান পার্টিতে ফের যোগ দেওয়ার পর থেকে ট্রাম্প দলের সবচেয়ে বড় দাতা ও তহবিল সংগ্রাহকে পরিণত হয়েছিলেন।
পর্যবক্ষেকদের ধারণা, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসায় গাজা, লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান বহুমুখী যুদ্ধে ইসরায়েল তার একচেটিয়া সমর্থন পাবে, এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। আবার ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপকে এড়িয়ে কিয়েভকে পাত্তা না দিয়ে মস্কোর সঙ্গে চুক্তির চেষ্টা চালাতে পারেন বলে মনে করেন কেউ কেউ।