বাংলাদেশে সবুজে আচ্ছাদিত ভূমির মধ্যে একটা বড় অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় এখনো কিছু বন–জঙ্গল টিকে আছে। তবে ক্রমাগত সংরক্ষিত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বনের গাছপালা নিধনে পাহাড়েও কমছে সবুজের আচ্ছাদন। তিন পার্বত্য জেলায় অনুমোদনহীনভাবে গড়ে ওঠা কোনো ইটভাটার পরিবেশ সংক্রান্ত কোনো ছাড়পত্র নেই। এ নিয়ে পরিবেশবাদীদের আপত্তি ও দাবির মুখে বিভিন্ন সময়ে অনুমোদনহীন ভাটাগুলো বন্ধ করা হলেও পরে আবার সচল করা হয়। বনের গাছ দিয়ে মাটি পুড়িয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে ইট।
২০২২ সালে হাই কোর্টের এক আদেশের পর তিন পার্বত্য জেলার ৬৪টি ইটভাটা বন্ধ করা হয়। পরে চালু হয় বন্ধ করা অনেক ইটভাটা। তবে সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে আগে বন্ধ করা ১৫টি ইটভাটা নতুন করে সচল করায় আবার বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। যদিও রাঙামাটি জেলার ইটভাটা নিয়ে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। অন্যদিকে রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকা থেকে বনের গাছ নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। এসব কাঠের একটা বড় অংশ যায় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার রাণীরহাট এলাকার ভাটাগুলোয়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটির কাউখালী ও রাজস্থলী ছাড়া বাকি আটটি উপজেলা কাপ্তাই হ্রদবেষ্টিত। এর মধ্যে রাঙামাটি সদর, নানিয়ারচর, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়িতে কোনো ইটভাটা নেই। তবে জেলার বাঘাইছড়ি, লংগদু, কাপ্তাই, রাজস্থলী ও কাউখালীতে ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার একটিরও নেই কোনো ছাড়পত্র। অনুমোদনহীন এসব ইটভাটায় দিনের পর দিনের পুড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বন–জঙ্গলের কাঠ। রাঙামাটির বনের গাছ যাচ্ছে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতেও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি হাই কোর্টে এক রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সকল ইটভাটার কার্যক্রম সাত দিনের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। ওই রুলে তিন জেলার বিভিন্ন স্থানে লাইসেন্সবিহীন সব ইটভাটা বন্ধে দায়ীদের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং অবৈধভাবে পরিচালিত ইটভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা পরিচালনার জন্য ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩–এর ধারা ৪, ৫, ১৪ ও ১৮ অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা চানতে চায় আদালত। এরপর নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় প্রশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ২০ উপজেলায় ৬৪টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)।
এরপর সেসব ইটভাটার বেশিরভাগ আবার সচল হয়েছে। ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর আবারও পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করতে তিন জেলা প্রশাসককে নোটিশ পাঠানো হয়। অন্যথায় জেলা প্রশাসকদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে এ নোটিশ পাঠান সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এরপর বেশ কিছু ইটভাটা বন্ধ করা হলেও চালু হয়েছে অনেকগুলো। তবে রাঙামাটি ও বান্দরবানের উপজেলাগুলোতে কয়টি ইটভাটা রয়েছে এ সংক্রান্ত তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অনুমোদনহীন হওয়ায় তথ্য পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছেও।
গত ২৩ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলা, দীঘিনালা, পানছড়ি, রামগড়, মানিকছড়ি ও গুইমারায় খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অনুমোদনহীন ১৫টি ইটভাটা বন্ধ করে সাড়ে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করে। তবে রাঙামাটি ও বান্দরবানের ইটভাটাগুলোয় পোড়ানো হচ্ছে বনের গাছ।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান আজাদীকে বলেন, যেসব ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার পর নতুন করে সচল করা হয়েছিল, সেগুলো সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের জানা মতে খাগড়াছড়িতে এখন আর কোনো ইটভাটা সচল নেই। বন্ধ করে দেওয়া এসব ভাটায় সাধারণত গাছ ও কয়লা দিয়ে মাটি পুড়িয়ে ইট প্রস্তুত করা হতো।
পরিবেশকর্মী ও সংগঠক সৈকত রঞ্জন চৌধুরী বলেন, পাহাড়ের গাছ দিয়ে কেবল রাঙামাটি জেলায় নয়, চট্টগ্রামের রাণীরহাটের অনেক ইটভাটায় ইট পোড়ানো হয়। এসব গাছ প্রশাসনের সামনে পাচার হচ্ছে। বছরের পর বছর তারা এভাবে গাছ কেটে পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দ্রুত এসব বন্ধের পাশাপাশি যারা এমন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ও উপ–বন সংরক্ষক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কাঠ বা গাছ পরিবহনের ক্ষেত্রে পরিবহন বিধিমালা অনুযায়ী বন বিভাগের জোত পারমিটের প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে গাছ পরিবহনের জন্য অনুমতি লাগে বন বিভাগের। আর বন বিভাগ জ্বালানির জন্য এ সংক্রান্ত কোনো পারমিট দেয় না। মূলত ইটভাটার বিষয়গুলো জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন দেখে। গত বছরও জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় সংরক্ষিত বনের পাশে গড়ে ওঠা কয়েকদিন স’মিল আমরা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় বন্ধ করেছি। প্রশাসন যদি সহযোগিতা চায় আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজন রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা আজাদীকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অনুমোদনহীন ইটভাটা বন্ধে হাই কোর্টের আদেশের পর প্রশাসন তড়িঘড়ি করে বেশ কিছু ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। যেগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনের গাছ পোড়ানো হতো। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর এখন আবার সেসব ইটভাটা চালু হচ্ছে। বেশিরভাগ সচল হয়েছে। অনুমোদনহীন ইটভাটা চালু অবৈধ এবং বনের গাছ পুড়িয়ে ইট তৈরিও নিষিদ্ধ। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে ইউএনওদের দিয়ে ইটভাটা মনিটরিং ও অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা জরুরি।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ আজাদীকে বলেন, রাঙামাটি জেলায় পরিবেশ–প্রকৃতি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে প্রশাসন কাজ করছে। গত শুক্রবারও কাউখালী উপজেলায় প্রশাসন পাহাড় কাটা সংক্রান্ত অভিযান পরিচালনা করেছে। অনুমোদনহীন ইটভাটা বন্ধে ইউএনওদের নির্দেশনা আছে। এক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতাও আছে। কাউখালী উপজেলার আশপাশের ঘটনাগুলোয় দেখা যায়, অনেক এলাকা রাঙ্গুনিয়ার মধ্যে পড়ে যায়, সেক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা যায়। ইটভাটায় বনের গাছ কাঠ পোড়ার বিষয় নিয়ে বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে প্রশাসন থেকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হবে।