ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৮:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে পত্রিকা প্রকাশনার মতো দুরূহ কাজ শুরু করে এতদঞ্চলের মানুষের অকৃত্রিম সুহৃদে পরিণত হওয়া আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের আজ ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। দেশের সংবাদপত্র শিল্পের অন্যতম অগ্রদূত, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এতদঞ্চলের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার হয়েও পত্রিকা প্রকাশনার মতো একটি অলাভজনক কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর সামনে নানা ধরনের সম্ভাবনা থাকলেও চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের কথা বলতে তিনি পত্রিকা প্রকাশনার দুরূহ কাজটি শুরু করেছিলেন।
আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে। সুলতানপুরের মতো একটি প্রত্যন্ত জনপদে জন্ম নিয়েও তৎকালীন নানা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে তিনি কৃতিত্ব রাখতে শুরু করেন। স্কুল এবং কলেজের পাঠ চুকিয়ে ভারতের শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। তিনিই এতদঞ্চলের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার। পাশ করার পর ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। চাকুরিকালীন তিনি চট্টগ্রামের বিদ্যুতায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পেশাগত জীবন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে তিনি চট্টগ্রামের প্রতি নানা বঞ্চনা খুব কাছ থেকে দেখেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সরকারের অবহেলা এবং সেই পূর্ব পাকিস্তানের অবহেলিত জনপদ চট্টগ্রামের মানুষের অভাব অভিযোগ তুলে ধরার পাশাপাশি মানুষকে শিক্ষিত এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য তিনি পত্রিকা প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ করেন। এখানকার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তিনি নিজেকে নিবেদিত করেন।
আজ থেকে প্রায় ৬২ বছর আগে এ অঞ্চলের মানুষ শিক্ষা-দীক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে পত্রিকা প্রকাশনা ছিল একেবারে অলাভজনক এবং অনিশ্চিত একটি পেশা। অথচ সরকারি লোভনীয় এবং নিরাপদ চাকুরি ছেড়ে আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার মানুষের কল্যাণে সেই পত্রিকা প্রকাশনার মতো কাজে আত্মনিয়োগ করেন। চট্টগ্রামের শিক্ষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে তিনি কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেস, কোহিনুর লাইব্রেরি এবং কোহিনুর পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের কল্যাণে নানামুখি চেষ্টা ছিল তাঁর। সেই চেষ্টারই অংশ হিসেবে তিনি বিভিন্ন প্রকাশনায় নিজেকে জড়িত করেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভাব অভিযোগ ওইসব প্রকাশনায় তুলে ধরতে লাগলেন।
৬২ বছর আগেকার পারিপাশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ যে কত কঠিন তা আজ কল্পনাও করা যাবে না। মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রামের মানুষের জন্য সেই কঠিন কাজটি বেছে নিয়েছিলেন। কেবল পত্রিকা প্রকাশ, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা বা ছাপাখানা স্থাপন করে তিনি ক্ষান্ত হননি, আলোকিত মানুষ তৈরির কাজেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এতদঞ্চলের কবি, সাহিত্যিক ও লেখক তৈরিতে রেখেছিলেন বিশেষ অবদান। আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের প্রত্যক্ষ সহায়তা পেয়ে অনেকেই পরবর্তীতে কবি এবং সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। একুশের প্রথম কবিতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ প্রকাশিত হয়েছিল কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেস থেকে। এই কবিতা প্রকাশের দায়ে কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেস বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছিল কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেসের মালিক আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মচারীদের। নানাভাবে ভোগান্তি সহ্য করেও পত্রিকা প্রকাশনা থেকে পিছপা হননি তিনি। পত্রিকা প্রকাশনার ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদী। আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের হাতে গড়া দৈনিক আজাদী গত প্রায় ৬২ বছর ধরে চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের কথা বলে আসছে। যেটি পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের মানুষের মুখপত্র হিসেবে।
উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত অলিয়ে কেরাম হযরতুল আল্লামা ছৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (রহ.) এর এতদঞ্চলের প্রথম খলিফা আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সৎ এবং ধর্মভীরু ছিলেন। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ মমত্ব। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি মানুষকে ভালোবেসে গেছেন। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের এই কৃতী পুরুষ আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তার অতিপ্রিয় অঙ্গন আন্দরকিল্ল্লাকে ‘ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক চত্বর’ হিসেবে নামাকরণ করেছে। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের নামে একটি হলের নামকরণ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার স্মৃতি বৃত্তি প্রদান করা হয় গত বেশ কয়েক বছর ধরে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা
পরবর্তী নিবন্ধসংকট উত্তরণে অর্থবহ সহযোগিতার ডাক