পর্ব–৩
পৃথিবীতে পরিপূর্ণ ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত আছে এরকম দেশের সংখ্যা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবে কিছু বিতর্কিত বিষয় বাদ দিলে দু/একটি দেশের নাম বলা যেতে পারে, যেমন–ইরান ও আফগানিস্তান। তারা আল্লাহর কোরানের শাসন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন: ইসলামের অন্যতম ফরজ বিধান পর্দা। যদিও হিজাব বিরোধী আন্দোলনে অনেকের মৃত্যু হয়েছে ইরানে– তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ইরান একটু কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। তবে এই ফরজ বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইরান বদ্ধপরিকর। যদিও তাদের আক্বিদা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। ওদিকে আফগানিস্তান আল্লাহর কোরআনের শাসন বাস্তবায়নের আপ্রাণ প্রচেষ্ঠা চালাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছে। অবশ্যই আল্লাহর কোরআন এবং রাসূল (সাঃ) এর হাদীস থেকে তিল পরিমাণ সরে পড়লে বিদগ্ধ ইসলামিক স্কলারদের নিকট থেকে সমালোচনা আসবেই–সবকিছু মাথায় রেখে আফগান প্রশাসনকে কোরানিক সাজে সাজিয়ে তুলতে হবে। বিতর্ক আর সমালোচনা থাকবেই কারণ আল্লাহর কোরানের শাসন অনেকেই পছন্দ করেন না। যদিও আমরা নিজেদের মুসলিম দাবি করি। অথচ মুসলিম হওয়ার পূর্ব শর্ত; আল্লাহর উপর ঈমান আনা এবং তাওহীদ এর উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখা। তাহলেই একজন মুসলমানের জন্যে ইসলামের ফরজ বিধানগুলো অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়। কারণ ইসলামের কিছু মানব আর কিছু অস্বীকার করব তাহলে তো একজন মুসলমান পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবেন না। ‘তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের এক অংশ বিশ্বাস কর এবং আরেক অংশ অবিশ্বাস কর? কখনও যদি কোন ব্যক্তি এই আচরণ করে, তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হবে যে, পার্থিব জীবনে তাদের লাঞ্চনা ভোগ করতে হবে–পরকালে তাদের কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে’–সূরা বাকারা–৮৫। পরিপূর্ণ মুমিনের গুণাবলী অর্জন করতে হলে ইসলামের মধ্যে নিজেকে পরিপূর্ণ দাখিল করতে হবে। ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হয়ে যাও এবং কোন অবস্থায় শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না’– সূরা বাকারা–২০৮। একজন মুসলমান নিজেই জানেন না– তিনি কত বিভ্রান্তির মাঝে অবস্থান করছেন। ঐ তথাকথিত মুসলিম নিজেই তৃপ্তির ঢেউ তুলে এই ভেবে যে, আমি তো আল্লাহর সব আহকাম–আরকান মেনে চলছি। তবে জান্নাতে যেতে আমার আর কোন বাধা নেই। ঐ ব্যক্তি মনে করে– ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান–খয়রাত, মানবসেবা, আত্নীয়–স্বজনের সাথে সম্পর্ক সবকিছু ঠিকঠাক করছি। অথচ ইসলামী হুকুমত আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠা করা কতই যে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত সেটা ঐ ব্যক্তির মাথার মধ্যেই আসে না। কারণ সেটি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সমাজের বড়সড় নেতা হওয়া যাবে না, অবৈধ পথে আয় করা যাবে না, বিভিন্ন নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে অন্যের উপর খবরদারি করা যাবে না, নামাজ–রোজা ঠিক রেখে সুদ–ঘুষ–দুর্নীতি করা যাবে না। আর তাই তো মৌলিক ফরজ বিধানগুলো ঠিক রেখে আকাম–কুকাম করার একটি মোক্ষম সুযোগ ইসলাম বিদ্বেষী কোন রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়া। কারণ আমার লেবাস ঠিকই আছে, দাঁড়ি–জুব্বা ঠিকই আছে কিন্তু অন্তরে লালন করি সেক্যুলাররীতি (কুখ্যাত কাফের আবু জেহেল এরও দাঁড়ি, জুব্বা ছিল)। আমার ভাবতে কষ্ট লাগে, অনেক নামধারী আলেম ওলামারাও মননে ও অন্তরে সেক্যুলাররীতি পোষণ করে প্রচলিত রাজনীতি করে দিব্যি ফায়দা লুটে যাচ্ছে (যেমন– সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মসজিদের খতিব, ইসলামী ব্যাংকসমূহের গভর্ণিং বডির মেম্বার কিংবা চেয়ারম্যান, এনজিও কিংবা ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর এমডি/চেয়ারম্যান, মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কিংবা শিক্ষক ইত্যাদি) আর এদের জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব। কারণ এরা আল্লাহর কোরানের অর্জিত এলেম দিয়ে নিজেকে সাজাতে পারেনি, সমাজকেও পারেনি। তাহলে বোঝা যায়– আল্লাহর কোরআন থেকে তাঁরা যে অর্জিত এলেম অর্জন করেছেন–জিন্দেগী ও আখেরাতে তার কোনই মূল্য নেই। কারণ– জিন্দেগীভর তারা ইসলাম বিদ্বেষী নীতিমালা কিংবা আইন–কানুন আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রত ছিলেন না। আমার আরও ভাবতে অবাক লাগে–এরা আল্লাহর কোরআনের সরল অনুবাদ এবং তাফসীর কি অধ্যয়ন করেননি কষ্মিনকালেও? যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে– ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম, মতবাদ, আদর্শ আল্লাহতায়ালা গ্রহণ করবেন না, ‘যদি কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন বিধান অনুসন্ধান করে তবে তার কাছ থেকে সে ব্যবস্থা কখনো গ্রহণ করা হবে না, পরকালে সে চরম ব্যর্থ হবে’– সূরা ইমরান– ৮৫। সে আয়াতটি কি ঐ সমস্ত তথাকথিত সেক্যুলার গোষ্ঠীর আলেম–ওলামারা পড়েননি? তাদেরেেক আমরা আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই’র অনুসারী বলতেও কোন দ্বিধা নেই। কারণ আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই আমার রাসূল (সাঃ) এর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেছেন এবং কয়েকটি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন। এরপরও এই মোনাফিকের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। কারণ ‘হে নবী তুমি কাফের ও মোনাফেকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তাদের উপর কঠোরতা অবলম্বন কর। তাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। আর তা এক নিকৃষ্ট ঠিকানা’– সূরা তাহরিম–৯। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মোনাফেকরা যখন তোমার কাছে আসে, তারা বলে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি– তুমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল (সাঃ)। আল্লাহতায়ালা জানেন তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর রাসূল (সাঃ): আল্লাহতায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, মোনাফেকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ সূরা–আল মোনাফেকুন–১।
ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের সবগুলোই ইক্বামতে দ্বীনের অংশ অবশ্যই কিন্তু কোরআনের শাসন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রবর্তন ইক্বামতে দ্বীনের একটি পরিপূর্ণ বিকাশ–এটা কতিপয় সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী মোটেই পছন্দ করেন না কিংবা অন্তরে থাকলেও তা প্রকাশ করেন না শুধুমাত্র দুনিয়াবী বাহ্বা/খেতাব হারানোর ভয়ে। আবার বিভিন্ন বিদগ্ধ আলেমেদ্বীন ইসলামের সহজ–সরল মাক্কী জীবনের বয়ান শুনিয়ে তাদের জ্ঞানের মাত্রা শেষ করে দেয় কিন্তু মাদানী যুগের কঠিন সময়গুলোর কথা মোটেই ব্যক্ত করেন না। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমার রাসূল (সাঃ) ও তাঁর খলিফা/সাহাবীগণ ১৩টি বছর ধরে যে কঠোর পরিস্থিতি কিংবা অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন না এবং তা যে শুধুমাত্র ঐ সময়ের জন্য নয় বরং আগামী কেয়ামত পর্যন্ত এই মাদানী যুগের আন্দোলন অব্যাহত থাকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে– সেটাও খোলাসাভাবে বলেন না শুধুমাত্র ইসলাম বিদ্বেষী শক্তির চোখ রাঙ্গানির ভয়ে অথবা দুনিয়াবি চাকরি হারানোর ভয়ে। আর এটাই আমাদের আলেমদের মাঝে আস্থার বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঠে ময়দানে এক আলেম অন্য আলেমকে তুলোধুনো করে ছাড়ি কিছু হালকা জিনিস নিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলি। অথচ এই ইক্বামতে দ্বীনের বিষয় নিয়ে অধিকাংশ আলেম–ওলামা কিংবা খতিব, আলেমগণ জোর গলায় বলি না। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে যেভাবে আমরা মাঠ কাঁপাই–যদি তার এক ছিটেফোঁটাও ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন– তাহলে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা এদেশে কায়েম করা সময়ের ব্যাপার মাত্র আর এখানেই আমাদের ঘাটতি রয়েছে প্রচুর। আবার অনেকই সুফিবাদ–মাইজভান্ডারি তরিকা–কাদেরিয়া তরিকা–রজভিয়া তরিকা এর মতন কোরআন হাদীস পরিপন্থি বিষয়গুলো এনে ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে আতুরঘরে পাঠিয়ে দেয়। অথচ তরিকা চলবে একমাত্র আমার রাসূল (সাঃ) এর। এই সমস্ত তথাকথিত তরিকার পেছনে তারা যেভাবে সময় দেয়–আমার রাসূল (সাঃ) এর তরিকা বাস্তবায়নের জন্য যদি তারা মেহনত করতেন তাহলে ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অনেক সহজ হয়ে যেত। আর এখানেই একটা বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। এরমধ্যে নিজের আমিত্ব, আমার সংগঠনটি একমাত্র সহীহ্–সমঝদার আর অন্য কোন সংগঠনে তা নেই–এ ধরনের মনোভাব পোষণ করা দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। একদিকে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুলো (যেখানে আলেম ওলামাদের একটি অংশ রয়েছে) ইসলাম বিরোধী প্রচারণায় যেভাবে লিপ্ত থাকে তা দেখেও অনেক আলেম–ওলামা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হক কথা বলার সাহস পায় না। আর এই হক কথা বলতে গেলেই নেমে আসবে ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতন আর নীপিড়নের অধ্যায়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, আদরের সন্তানাদি থেকে বিচ্ছিন্ন, আত্নীয়–স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন, চাকুরীচ্যুত ইত্যাদি। এই অপমান আর অপ্রাপ্তি যারাই নিজেদের জীবনের অঙ্গ হিসাবে বেছে নিয়েছেন তারাই সত্যিকার হকের উপর দাঁড়িয়ে আছে আজও। আর এজন্যই এই পৃথিবীটা এত সুন্দর এবং নির্মল।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল