তিন শূন্যের প্রবক্তা, দরিদ্রমুক্ত বিশ্ব গড়তে সামাজিক ব্যবসাতত্ত্বের উপস্থাপক বীর চট্টলার কৃতী সন্তান নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে চট্টলবাসী গড়ে তুলেছিল ‘ইউনূস সুহৃদ’ নামক একটি প্রতিবাদী সংগঠন। সেদিন গর্জে উঠেছিল বীর চট্টলা। আমরা বীর চট্টলার নারী পুরুষ সর্বস্তরের নাগরিক একাট্টা হয়েছিলাম আঁরার চাটগাঁইয়া ইউনূসের বিরুদ্ধে সকল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রুখে দিতে। ৩১/০৫/১২ তারিখে সরকার ড.ইউনূসের তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে একটি কমিশন গঠন করে। পরবর্তীতে তা অন্যায়ভাবে দখল করে। চট্টগ্রাম গর্জে ওঠে। বিখ্যাত কলামিস্ট ইবনে সাজ্জাদ দৈনিক আজাদী পত্রিকায় তাঁর ‘বিরস রচনা’ উপসম্পাদকীয়তে লিখেন ‘আঁরার ইউনুছরে লয় এত টালটি ফালটি ক্যায়া’ শীর্ষক এক রম্য রচনা। চট্টগ্রামের আজাদী ও অন্যান্য পত্রিকাগুলো তাঁর বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। ‘ইউনূস সুহৃদ’ নামক সংগঠন এর পতাকাতলে সমবেত হয়ে নানা প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারিত হতে থাকে। জালিম সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চট্টলবাসী প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলো তা আজ পূর্ণ হতে চলেছে। মজলুম মানুষটির তিলে তিলে গড়া গ্রামীণ ব্যাংক দখল, তাঁকে নানা মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে নিপীড়ন, নির্যাতন তিনি হাসি মুখে সহ্য করে গেছেন। তাঁর বন্ধু–বান্ধব ও সুহৃদরা মিলে তাঁর নিজের জেলা শহর চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চিটাগাং সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’। এ–প্রতিষ্ঠান থেকে বিনা সুদে ঋণ নিয়ে অনেকেই পর্যায়ক্রমে স্বাবলম্বী হতে শুরু করে। মহামারী কোভিড ১৯ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এ–মহৎ কমিটির কর্মকাণ্ড পুরোপুরি সচল রাখা সম্ভব হয়নি। সকল নির্যাতন, হয়রানি, অপমান ও হয়রানির অবসান হয়েছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ত্যাগ, জীবন ও রক্তের বিনিময়ে। আমাদের চাটগাঁইয়া ইউনূস আজ দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব লাভে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। আমরা আরো আনন্দিত আমাদের আরেক সহযোদ্ধা ও নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম বীর প্রতীককে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ করায়।
ইউনূস সুহৃদ থেকে চিটাগাং সোশ্যাল বিজনেস সেন্টারের পক্ষে প্রফেসর মু. সিকান্দর খান, সাবেক চেম্বার প্রেসিডেন্ট আমির হুমায়ূন মাহমূদ চৌধুরী, একুশে পদকপ্রাপ্ত আজাদী সম্পাদক এম. এ মালেক, ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক, সাংবাদিক ওসমান গণি মনসুর, কলামিস্ট শাখাওয়াত হোসেন মজনু, মোসলেহ উদ্দিন মোঃ খালেদ, মোঃ মুজিবুল কাদের, মোঃ কালাম উদ্দিন, জিয়া উদ্দিন খালেদ, এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান, লায়ন মোঃ মোস্তাক হোসাইন, আবিদা সুলতানা, এডভোকেট সৈয়দ আনোয়ার হোসাইন, ডা. কিউ এম অহিদুল আলম, সেতারা গাফ্ফার, ব্যাংকার মুজিবুল কাদের, মোঃ আমিরুল ইসলাম, মোঃ আব্দুল বাতেন, মোঃ আমিনুল হক, ফয়সাল মোঃ আশরাফ, এড মোহাম্মদ ইদ্রিছ, ইয়াসিন মাবুদ, প্রফেসর মোসলেহ উদ্দিন চৌধুরী খালেদ, আবিদা সুলতানা, নাসির উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ সহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা মিলে গড়ে তুলে ছিলেন ‘চট্টগ্রাম সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি। আমরা আন্তর্জাতিক সোস্যাল বিজনেস সামিটগুলোতে অংশ নিয়ে আমাদের কার্যক্রম তুলে ধরি।
যা শুনে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ, সমবায় আন্দোলন ও গ্রাম উন্নয়নে আমার মরহুম পিতা এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা, মাহবুব আলম চাষী, বাবু সন্তোষ দাশ, প্রয়াত সি.সি.বর্মন, ডাঃ আবুল কাসেম এম. পি, দৈনিক আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সাংবাদিক ফজলুল রহমান, ননী গোপাল চৌধুরী, প্রফেসর এ.কে.এম. আহমেদ উল্লাহ, ড. এ. এইচ. লতিফি, মনোতোষ দাশ, আনোয়ারুল আজিম (ভোলা মিয়া) প্রমুখের সাথে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম অনায়াসে এসে যায়। স্বনির্ভর গ্রাম, স্বনির্ভর দেশ গড়তে তাঁরা জাতির জনক স্বাধীনতার স্থপতি মরহুম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সাড়া দিয়ে যুগপৎভাবে কাজ করে যান। এদেশের সমবায় আন্দোলনে তাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে প্রফেসর ইউনূসের অবদান প্রসঙ্গে ইউ এস প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক সমাজ কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত স্মরণিকা ‘গ্রামীণ’ এর ৩২ পৃষ্ঠায় কাজী আশরাফ হোসেন রচিত ‘গ্রামীণ ব্যাংক: ইউনূসের চিন্তাধারা‘ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ (চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা শোনার পর টেনেসির ন্যাসভিলে অবস্থিত হাতে গোনা যে কয়জন বাঙালিকে পেয়েছেন তাদের সবাইকে নিয়ে (মোট ৬ জন) ২৯ মার্চ এক বৈঠকে বসেন তিনি এবং অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। আর তা হলো এরকম– অনুষ্ঠানে আগত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনই এই স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা প্রেক্ষাপটকে আরো বেশি বেশি খোঁজ খবর নেওয়ার উপর জোর দেন। ঠিক তখনই আজকের এই নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। আমি আমার নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে ঘোষণা দিলাম– যারা আমার সাথে হাত মিলাবেন না তারা আমার চোখে পাকিস্তানী এক কথায় বাংলাদেশের শত্রু। অগাধ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত সকলেই বাংলাদেশের পক্ষ নিল এবং তাৎক্ষণিকভাবেই গঠিত হলো বাংলাদেশী নাগরিক সমিতি (উদ্ধৃতি সেলিনা সিরাজ, শিপ্রা চক্রবর্তী)’ । এভাবে ড. ইউনূসের দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় । ১৯৭৩ সালের ২৬, ২৭ ও ২৮ শে সেপ্টেম্বর বৃহত্তর চট্টগ্রাম থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি সমূহের ফেডারেশন কর্তৃক আয়োজিত এক কৃষি সমবায় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন তদানীন্তন কুমিল্লা বি.এ.আর.ডি এর ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুব আলম চাষী। যার সভাপতি ছিলেন প্রফেসর ড. ইউনূস ও সম্পাদক ছিলেন আমার মরহুম পিতা এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্যয়্যা। ষাটের দশকে তাদের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামে নিবিড় চাষাবাদ ইরি, বেরো ধান চাষের প্রবর্তন হয়। পরবর্তীতে এতদাঞ্চলে সমবায়ের মাধ্যমে ‘কানী প্রতি একশ, যার নাম সোনালী শ‘ আন্দোলন সফল হয়। প্রফেসর ড. ইউনূসের নাম হাটহাজারী জোবরা গ্রামের তেভাগা আন্দোলনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এক সময় তিনি বন্ধক বিহীন বিনিযোগ পদ্ধতির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্ভব ঘটান। আজ তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিও ২০১৬ অলিম্পিকের মশাল বহন করেন প্রফেসর ইউনূস। বিপুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ২০০ মিটার হেঁটে দেখালেন আমাদের গর্বের ইউনূস। একহাতে মশাল আর অন্য হাত তুলে তিন আঙ্গুল প্রদর্শন, যার উদ্দেশ্য ছিল ‘তিন শূন্য‘র লক্ষ্য অর্জনে বিশ্ববাসীকে উদ্ধুদ্ধ করা। শূন্য‘র অর্থ হচ্ছে– সামাজিক ও পরিবেশ লক্ষ্য অর্জনে ‘শূন্য দারিদ্র’, ‘শূন্য বেকারত্ব’ ও ‘শূন্য এ ‘তিন ‘নীট কার্বন নিঃসরণ’। তিনি অলিম্পিকের সকল কর্মসূচিতে একটি সামাজিক মাত্রা যোগ করার জন্য প্রচারণা চালান যা তাঁর ভাষণের মূল বক্তব্যেও প্রতিফলিত হয়। ‘চাকরি নেব না, চাকরি দেব’; ‘মানুষ কোনোভাবে বেকার হতে পারে না’ তাঁর এসব প্রাণজয়ী, কালজয়ী বক্তব্য আমাদের জাগিয়ে তোলে। তিনি আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। দেশ গড়ায় বিশ্ব গড়ায় এমন চেতনা এ মুহূর্তে অত্যন্ত প্রয়োজন। সামাজিক ব্যবসার ধারনার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোর তাঁর সহজ সূত্র বিশ্ববাসীকে আকর্ষিত করেছে।
২০১৪ সালে নভেম্বর মাসে চিটাগং স্যোসাল বিজনেস সেন্টার লিঃ এর চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয় প্রফেসর মু. সিকান্দর খান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমির হুমায়ূন মাহমুহ চৌধুরী, ডিরেক্টর মোহাম্মদ আব্দুল মালেক (দৈনিক আজাদী সম্পাদক) ফ্লোবাল সোশ্যাল বিজনেস সামিট–মেক্সিকোতে অংশগ্রহণ করেন। চিটাগং সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার লিঃ পাওয়ার পয়েন্ট প্রজেনটেশানের মাধ্যমে সিএসবিসিএল এর সাংগঠনিক কাঠামো, আদর্শ এবং কর্মপন্থা উপস্থাপন করলে সেখানে তা ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। ড. ইউনূস ভিক্ষাবৃত্তিকেও ঘৃণা করেন। তিনি দানকে অর্থবহ করে তুলেন তা রিসাইক্লিং– পদ্ধতির মাধ্যমে। সামাজিক ব্যবসায় দানকৃত অর্থ বহুগুণে বার বার ফিরে আসে আরো বেশি বিনিযোগ শক্তি নিয়ে। আমার মরহুম পিতার এ– ঘনিষ্ঠজন মুক্তমনের সহজ সরল চাঁটগাইয়া মানুষটির সান্নিধ্যে যখনি গিয়েছি তখনই কাছে টেনে নিয়ে অনবদ্য ভালোবাসা ও প্রাণখোলা হাসিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি। মানুষকে আপন করে নেয়ার এক জাদুকরি শক্তি তাঁর মাঝে কাজ করে। ইউনূসের নোবেল বিজয়ে সেদিন মনে হয়েছে কেনো ব্যক্তি নয় ‘বাংলাদেশ নোবেল পেয়েছে’। কিন্তু তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে উপযুক্ত সম্মান পাওয়া দূরের কথা বরঞ্চ বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। অথচ তিনি এদেশের অর্থনীতিকে জোরদার করে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে গড়ে তুলতে যে সংগ্রাম শুরু করেছেন, তা আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। কেননা স্বাধীনতা অর্জন অপেক্ষা তাকে রক্ষা করা আরো কঠিন এবং মহান দায়িত্ব।
সামাজিক ব্যবসায় পৃথিবীতে অনন্য বিপ্লব সৃষ্টিকারী, দারিদ্র্য বিমোচন প্রবক্তা এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ী চট্টলার গৌরব এতদসঙ্গে ইউনূস বাঙালি জাতির অহংকার। পতিত সরকার না পারলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বীর মুক্তিকামী শিক্ষার্থীরা তাঁকে উপযুক্ত মর্যাদায় ভূষিত করেছে। তিনিও তাঁর সন্তানদের আহ্বান ফিরিয়ে দিতে পারেননি। আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যথোপযুক্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেকে একটি মর্যাদাবান সম্মানিত জাতি ও মুক্ত চিন্তার দেশ হিসেবে পরিচিত ঘটাই। ড. ইউনূস দীর্ঘজীবী হোন।
লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, সু–শাসন ও মানবাধিকার কর্মী।