আয়তন নয়, বাড়ছে শহরের জনসংখ্যা

মোরশেদ তালুকদার | মঙ্গলবার , ১১ জুলাই, ২০২৩ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

গত ১১ বছরে চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে ৬ লক্ষ ৩৮ হাজার ৭৮ জন। অথচ এ সময়ে বাড়েনি শহরের আয়তন। বরং কর্মক্ষেত্র, উন্নত জীবনযাপন এবং নাগরিক সুযোগসুবিধার লোভে চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রতিবছর অসংখ্য লোক ভিড় করছেন ৬০ বর্গমাইলের এ শহরে। দেশের অন্যান্য জেলা থেকেও আসছেন অনেকে। ফলে প্রতিনিয়ত বর্ধিত এ জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে শহরে। বিশেষ করে নাগরিক সুযোগসুবিধা নিশ্চিতে জড়িত এখানকার সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাশিত প্রতিষ্ঠানের উপর। তবে নানা সীমাবদ্ধতা থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো সে চাপ সামলাতে ‘হিমশিম’ খাচ্ছে। এ অবস্থায় উপজেলা পর্যায়ে সুযোগসবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে শহরে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ কমাতে পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জনসংখ্যার চাপ সামলানোর এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আজ পালিত হবে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘জেন্ডার সমতাই শক্তি: নারী ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে হোক পৃথিবীর অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন’। ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই প্রথম বারের মতো ৯০টি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।

শহরের জনসংখ্যা কত : জনশুমারি ও গৃহগণনা২০২২ অনুযায়ী বর্তমানে নগরের জনসংখ্যা ৩২ লক্ষ ৩০ হাজার ৫১৭ জন। যা ২০১১ সালে আদম শুমারির তথ্য অনুযায়ী ছিল ২৫ লক্ষ ৯২ হাজার ৪৩৯ জন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শহর এবং উপজেলা মিলিয়ে পুরো চট্টগ্রাম জেলার জনসংখ্যা ৯১ লক্ষ ৬৯ হাজার ৪৬৪ জন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিসংখ্যান অফিসের পরিচালক, মো. ওয়াহিদুর রহমান বিষয়টি দৈনিক আজাদীকে নিশ্চিত করেন।

এদিকে সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা শহরের জনসংখ্যা পরিসংখ্যান ব্যুরোর চেয়েও বেশি দাবি করে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন নথিতে উল্লেখ করা হয়, শহরের জনসংখ্যা আনুমানিক ৬০ লক্ষ। এছাড়া ভাসমান আছে আরো ১৫ লক্ষ। সর্বশেষ সংস্থাটির চলতি ২০২৩২০২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রতিবেদনে ৭০ লক্ষ দাবি করা হয়। যদিও ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যাত্রার সময় ছিল ২০ লাখ।

সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য অনুযায়ী, নগরের আকবর শাহ থানার জনসংখ্যা ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৬৬০ জন। এছাড়া বাকলিয়া থানায় ২ লক্ষ ২৬ হাজার ২৪৩ জন, বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ৩ লক্ষ ৯২ হাজার ২৫৮ জন, চকবাজার থানায় ১ লক্ষ ১৭ হাজার ৯৮ জন, চান্দগাঁও থানায় ৩ লক্ষ ১২ হাজার ২৬১ জন, বন্দর থানায় ১ লক্ষ ৭১ হাজার ২৪ জন, ডবলমুরিং থানায় ২ লক্ষ ৪৯ হাজার ৩৮৯ জন, ইপিজেড থানায় ২ লক্ষ ৫৬ হাজার ১৬৮ জন, হালিশহর থানায় ২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৪৪৩ জন, খুলশী থানায় ২ লক্ষ ৭ হাজার ৭৭৫ জন, কোতোয়ালী থানায় ২ লক্ষ ৩১ হাজার ৬৫১ জন, পাহাড়তলী থানায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার ৮৬ জন, পাঁচলাইশ থানায় ২ লক্ষ ১৯ হাজার ৮৪৫ জন, পতেঙ্গা থানায় ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ১৬৯ জন, সদরঘাট থানার জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৬ হাজার ৪৪৭ জন।

বাড়ছে নানামুখী চাপ : জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আবাসনসহ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির নানা সুযোগ বৃদ্ধির চাপ বাড়ছে। যেমন খাদ্যের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসর ওপর চাপ বাড়ছে। এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নের চাপ আছে সেবাসংস্থাগুলোর ওপর। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাহিদাগুলোর চাপ মোকাবিলা করতে পারছে সংস্থাগুলো। তবে নাগরিকদের অভিযোগও আছে।

নাগরিকদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলছেন, সবচেয়ে বেশি চাপ বাড়ছে আবাসনে। কারণ বিগত সময়ে জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি ভূমির সংখ্যা। এখন প্রশ্ন অপরিবর্তিত ভূমিতে পরিকল্পিতভাবে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে? আবাসন নিয়ে কাজ করেন এমন সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, হয়নি। শুধু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১৬০ বছরের ইতিহাসে নয়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৬৪ বছরের ইতিহাসেও কাঙ্ক্ষিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

অথচ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব নগরবাসীর আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু এসব সংস্থার পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে এগিয়ে আসে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শুরুতে ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের পক্ষে আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে কিস্তি সিস্টেম চালু হলে কিছুটা সাহস করে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। তবে তার সংখ্যা খুব কম।

এছাড়া চট্টগাম শহরে জনসংখ্যার অনুপাতে কমপক্ষে ২৫টি সরকারি স্কুলের চাহিদা আছে। অথচ বর্তমানে আছে মাত্র ১০। ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বাড়লে স্কুলের চাহিদা আরো বাড়বে। একইভাবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদাও তৈরি হবে। সরকারি স্কুলকলেজের সংখ্যা কম থাকার সুযোগে বাড়ছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অভিযোগ আছে, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই বাণিজ্যিকীকরণ করছে শিক্ষা নিয়ে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে সুপেয় পানির চাহিদাও। এতে চাপ বাড়ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার উপর। ২০১১ সাল পর্যন্ত নগরীতে সুপেয় পানির চাহিদা ছিল দৈনিক ৫শ মিলিয়ন লিটার। এর বিপরীতে ওয়াসা সরবরাহ করতে পেরেছিল ২১০ মিলিয়ন লিটার। বর্তমানে চাহিদা তৈরি হয়েছে ৫০ কোটি লিটার। যদিও ওয়াসা সব চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।

বড় আঘাত পরিবেশের উপর : জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসছে পরিবেশের ওপর। চাহিদার বিপরীতে আবাসনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা করা হচ্ছে। এইক্ষেত্রে ভূমির ব্যবহার হচ্ছে অপরিকল্পতিভাবে। এবং প্রথম আঘাতটি আসছে পাহাড়ে। এরমধ্য দিয়ে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে পরবর্তী ১২ বছরে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাহাড় নিধন। এ সময় বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ষোলশহর ও ফয়’স লেকে। এর আগে ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৩২ বছরে নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয়।

এদিকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থলী বর্জ্য ও শিল্প বর্জ্যেও নষ্ট হচ্ছে নগরের পরিবেশ। যেমন নগরে দৈনিক আড়াই হাজার টন গৃহস্থলী ও মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দাবি করেছে, তারা ৯৫ শতাংশ অপসারণ করে। বাকিগুলো খালনালায় মিশে। চসিকের বক্তব্য সত্য ধরে নিলেও দৈনিক ৫ শতাংশ বা ১২৫ টন বর্জ্য খালনালায় পড়ে। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশন শহরের কঠিন বর্জ্য হালিশহর ও আরিফিন নগর এলাকায় উন্মুক্ত স্থানে ডাম্পিং করে। সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় এসব বর্জ্য বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদীর পানিতে মিশছে।

উপজেলায় সুযোগ বৃদ্ধির পরামর্শ : সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, শহরের জনসংখ্যা বাড়লেও পরিধি বাড়ছে না। যদি উপজেলা পর্যায়ে ডেভেলাপমেন্ট বাড়ানো যায় এবং আমাদের পাওয়ারকে যদি ডিসেন্ট্রালাইজড করি তাহলে বিপুল জনগোষ্ঠী যারা শহরমুখী হচ্ছেন তাদের বিরত রাখা যাবে। শহরের যেসব সুবিধা আছে সেটা যদি উপজেলাভিত্তক গড়ে তোলা যায় তাহলে শহরে জনসংখ্যার চাপ কমবে এবং গ্রামও দিন দিন উন্নত হবে।

তিনি বলেন, সরকারিভাবে স্কুলকলেজ উপজেলা পর্যায়ে বাড়ানো যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবে মানুষ যদি উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ে সুযোগসুবিধা পায় তাহলে শহরমুখী হবে না। তখন বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ থেকে শহরকেও রক্ষা করা যাবে। সুযোগসুবিধা যদি কেবল শহরে বাড়ানো হয় তখন উপজেলা থেকেও লোকজন শহরমুখী হবেন। তাই সবকিছু ডিসেন্ট্রালাইজড করতে হবে।

১৫ উপজেলার জনসংখ্যা : সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণণার তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার জনসংখ্যা ৩ লক্ষ ১৯ হাজার ৪৮০ জন। এছাড়া বাঁশখালী উপজেলায় ৫ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫৯৩ জন, বোয়ালখালী উপজেলায় ২ লক্ষ ৫৮ হাজার ৬৮৮ জন, চন্দনাইশ উপজেলায় ২ লক্ষ ৫২ হাজার ২৫৫ জন, ফটিকছড়ি উপজেলায় ৬ লক্ষ ৪২ হাজার ৮৯ জন, হাটহাজারী উপজেলায় ৪ লক্ষ ৯৮ হাজার ১৭২ জন, কর্ণফুলী উপজেলায় ২ লক্ষ ৩ হাজার ৭০৭ জন, লোহগাড়া উপজেলায় ৩ লক্ষ ২৮ হাজার ২৩১ জন, মীরসরাই উপজেলায় ৪ লক্ষ ৭২ হাজার ৭৯৪ জন, পটিয়া উপজেলায় ৩ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬৭৮ জন, রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৩ লক্ষ ৯২ হাজার ৯০৩ জন, রাউজান উপজেলায় ৩ লক্ষ ৯৬ হাজার ৩৫৮ জন, সন্দ্বীপ উপজেলায় ৩ লক্ষ ২৭ হাজার ৫৬৪ জন, সাতকানিয়া উপজেলায় ৪ লক্ষ ৫৪ হাজার ৯৩ জন এবং সীতাকুণ্ড উপজেলার জনসংখ্যা ৪ লক্ষ ৫৭ হাজার ৩৯৬ জন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফেব্রুয়ারিতে ফিরছে এসএসসি, পরীক্ষা হবে সব বিষয়ে
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় চোর সন্দেহে যুবককে পিটিয়ে হত্যা