উনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে আমাদের সমাজ ছিলো স্থানুবৎ স্থির, অচঞ্চল। তখন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়নি। রাজনীতির চর্চা আরো পরের ঘটনা। তবে রাজনীতির চর্চা না থাকলেও সমাজ ছিলো। সমাজ চলতো আপন নিয়মে, সমাজদেহ থেকেই কোন কোন মানুষ উদ্ভূত হতেন, যাঁরা সমাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নানা কর্মযজ্ঞের আয়োজন করতেন। সমাজ সংস্কারক, সমাজহিতৈষী, সমাজসেবী, সমাজকর্মী ইত্যাদি নানা পরিচয়ে তাঁদেরকে চেনা যায়।
আমাদের চট্টগ্রামে এমনি সমাজসেবকের কথায় চারটি নামই সর্বাগ্রে মনে পড়ে। তাঁরা হচ্ছেন–খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বিএ, খান বাহাদুর ফজলুল কাদের, নুর আহমদ চেয়ারম্যান, ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী। তাঁরা উনিশ শতকের মানুষ; বিশ শতকেও দু’জন সমাজকর্মীর সাক্ষাৎ মেলে–বাদশা মিয়া চৌধুরী ও ফজল করিম চেয়ারম্যান। তাঁরাই একটি দু’টি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন শুরু করলে সমাজের অন্ধকার ঘুলঘুলি পথে শিক্ষার আলো প্রবেশ করে একটি বাতায়ন খুলে যায় এবং মাতাল হাওয়ার লুটোপুটি পড়ে যায়। এই শিক্ষাই সমাজের চালিকা শক্তির আসন গ্রহণ করে।
সমাজকে আলোকিত করার জন্য, সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য শিক্ষাই প্রাথমিক শর্ত–এমন উপলব্ধি থেকে উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতায়ার্ধ থেকে চট্টগ্রামে মুসলমান সমাজে নবজাগরণ শুরু হয়। আহমদ হোসেন খান এমনি একজন শিক্ষাব্রতী, যিনি পশ্চিম পটিয়ায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি চাকরি করতেন রেলওয়েতে, কিন্তু তাঁর জীবনকে নিবেদিত করেছিলেন শিক্ষাসাধনায়।
পটিয়া থানার হুলাইন গ্রামের রেল কর্মকর্তা আহমদ হোসেন খানের সমাজকর্মী হয়ে ওঠার গল্পে চমৎকারিত্ব আছে, অসাধারণত্বও আছে। তবে ওপরে যাঁদের কথা বলা হলো, তাঁদের মতো হাই প্রোফাইল মানুষ তিনি ছিলেন না। কিন্তু লো প্রোফাইলের মানুষ হয়েও তিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য যা’ করেছিলেন, তাতে তিনি হাই প্রোফাইলের সঙ্গে একাসনে উপবিষ্ট হয়ে নিজের ওয়ার্থ প্রমাণ করেছিলেন।
আহমদ হোসেন খান ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম পটিয়া, পশ্চিম বোয়ালখালী ও আনোয়ারা উপজেলা তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামের অভিভাবক ও ছাত্র–ছাত্রীদের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উক্ত এলাকাসমূহের কেন্দ্রস্থল আরাকান সড়কের নিকটবর্তী হুলাইন গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে সময় বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিল্পপতি আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও তাঁর ভাই নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর মত বিদ্যোৎসাহী ও বিত্তশালী মানুষকে তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন। উক্ত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের তাগিদে কলেজ পরিকল্পনা কমিটির আহবায়ক হিসেবে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচরিয়া দীঘির পাড়স্থ হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় প্রাঙ্গণে এক জনসভার আয়োজন করেন। উক্ত সভায় প্রয়াত মন্ত্রী ও বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। “হুলাইন ছালেহ–নূর কলেজ” নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জনাব আহমদ হোসেন খান প্রথম প্রস্তাব করেন। তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যাবতীয় কাজের দায়িত্বভার পালন করেন। তিনি দীর্ঘকাল কলেজের সম্পাদক ও আজীবন পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
আহমদ হোসেন খান এমনই একজন শহরে উদার শিক্ষাব্রতী ছিলেন যে তিনি তাঁর শিক্ষা বিস্তারের মিশন স্বগ্রাম হুলাইন ছাড়িয়ে সুদূর পটিয়া এবং চট্টগ্রাম শহরে পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
পটিয়া কলেজে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া কলেজ সাংগঠনিক ফাইন্যান্স কমিটির সদস্য ছিলেন। জে. এম. সেন মহাবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম–এর ১৯৭২–১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কার্যকরী সংসদের সদস্য ছিলেন। হুলাইন হযরত ইয়াছিন আউলিয়া হামিদিয়ে আবেদিয়ে সিনিয়র মাদ্রাসা পরিচালনা সংসদের বহু বছর যাবৎ সহ–সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তৎসংলগ্ন মসজিদ, মাজার ও কবরস্থান সংস্কারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি হাবিলাসদ্বীপ উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৫ বছরেরও অধিক সময় পরিচালনা সংসদের সদস্য ছিলেন। হাবিলাসদ্বীপ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৫ বছরের অধিক সময় সহ–সভাপতি ও সদস্য হিসেবে জড়িত ছিলেন। দেশ বিভাগের পর হতে প্রায় ২৫ বছরেরও অধিক সময়ে তিনি হুলাইন আমিন শরীফ চৌধুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সহ–সভাপতি, সম্পাদক ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হুলাইন জরিনা বেগম এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু নিরলসভাবে নিজেকে নিয়োজিত রেখে অসংখ্যা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সেবামূলক ও উন্নয়নমূলক কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সদালাপী, সরল, ধর্মভীরু, সৎ, শিক্ষানুরাগী এবং সমাজসেবক ছিলেন।
আহমদ হোসেন খান ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে স্ব–গ্রামে ‘হুলাইন এথলেটিক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করে ২০ বছরাধিককাল উক্ত প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন পদে থেকে গ্রামের মধ্যে খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং বন্যা–জলোচ্ছ্বাসের সময় বিভিন্ন সেবামূলক কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
হুলাইনে কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি; ছালেহ–নূর কলেজ তাঁরই ব্রেইন চাইল্ড। তিনি শুধু কলেজের স্বপ্নদ্রষ্টা নন, সার্থক রূপকারও। টাকা–পয়সা অনেকেরই থাকে, কিন্তু সে টাকা–পয়সা সৎ কাজে ব্যয় করার মানসিকতা সকলের থাকে না। শিক্ষার জন্য টাকা–পয়সা খরচ করতে হলে মন থাকতে হবে। শিক্ষার প্রতি দরদ বা শিক্ষানুরাগ না থাকলে শিক্ষা প্রসারের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদানের মনোবৃত্তি জাগ্রত হতে পারে না। আহমদ হোসেন খান অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের আগ্রহ আছে। সেই আগ্রহটা উস্কে দেয়া দরকার। আহমদ হোসেন খান সাহেব সে কাজটিই করেছিলেন।
অথচ কী পরিশ্রমটাই না তিনি করেছেন কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আসাম–বেঙ্গল রেলওয়ের কর্মকর্তা ছিলেন তিনি, পরে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের কর্মকর্তা। কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তাঁর আর নাওয়া–খাওয়া ছিলো না। কোথায় অফিস, কোথায় বাড়ি। অফিসে গিয়ে হাজিরা খাতায় দস্তখতটা করে কোটটা চেয়ারে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তেন কলেজের কাজে; কলেজের কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট মানুষজনের দুয়ারে দুয়ারে, তাদের অফিসে বাসায় বাসায় আহমদ হোসেন খানের ধর্ণা দেয়াই ছিলো তাঁর কাজ। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঘেমে নেয়ে একসা তবুও অক্লান্ত আহমদ হোসেন খান। গ্রামের মেঠো পথ, আল পথ, কর্দমাক্ত রাস্তা মাড়িয়ে ছাত্রুছাত্রীর অভিভাবকের বাড়ি, কলেজ কমিটির সদস্যদের কাছে ছুটে যাবার বিরামহীন পথচলা। নিজের ঘরবাড়ি, ছেলেমেয়েদের প্রতিও কোন দৃষ্টি ছিলো না তাঁর। দিন নেই রাত নেই, ঘুম নেই, কলেজই ছিলো তাঁর ধ্যানজ্ঞান। যতদিন কলেজ হয়নি, বিশ্রাম ছিলো না তাঁর ।
আহমদ হোসেন খান ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নজির আহাম্মদ খান ও মাতার নাম বলকিস খাতুন। তিনি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া উপজেলাধীন আশিয়া গ্রামের মল্ল গোষ্ঠীর আনোয়ার আলী চৌধুরীর নাতনি ও কাদের বক্স চৌধুরীর ১ম মেয়ে নুর জাহান বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর ২ ছেলে এবং ৩ মেয়ে।
তাঁর প্রথম ছেলে আফছার হোসেন খান গ্র্যাজুয়েশন শেষে সোনালী ব্যাংক–এর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ২য় ছেলে মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি শেষে হুলাইন ছালেহ–নুর কলেজে প্রায় পাঁচ বছরকাল প্রভাষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড এর সিনিয়র কর্মকর্তা আমজাদকে পিতার যোগ্য উত্তরসূরী বলা যায়। পিতার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর ছেলেমেয়ে ও বোনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে পিতার নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আহমদ হোসেন খানের তিন মেয়ের মধ্যে প্রথম মেয়ে মরজিয়া বেগম পটিয়া আল্লাই ওখারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও তাঁর স্বামী পটিয়া প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণালয়ে (পি,টি,আই) সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন। দু’জনই পরলোকগত। তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে হাছিনা খানম মধ্যম শিকলবাহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক এবং তাঁর স্বামী সোনালী ব্যাংক এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। তাঁর তৃতীয় মেয়ে সাহেদা বেগম স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং তাঁর স্বামী কৃষি ব্যাংক এর ম্যানেজার ছিলেন। আহমদ হোসেন খান ছাত্র–শিক্ষক ও গণমানুষের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে বর্ণময় ভরপুর জীবনযাপন করে ৬৩ বছর বয়সে ১ এপ্রিল ১৯৮৮ শুক্রবার রাত বারটার সময় হুলাইন গ্রামের নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।