আসুন, বধ্যভূমিতে কাটিয়ে যান আপনার নিরাপদ জীবনের একটি দিন

শিশির ভট্টাচার্য্য | শনিবার , ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ


সংঘাত প্রবণ প্রাইমেট মানুষ অতীতেও পরষ্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, বর্তমানেও যুদ্ধ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হতো, উলুখাগড়া জনগণের উপর তার প্রভাব হয়তো পড়তো না খুব একটা। কিন্তু আধুনিক যুগে ‘কান টানলে মাথা আসে’-র মতো যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যুদ্ধাপরাধ- খুন হয় নিরপরাধ মানুষ, শিশু, ধর্ষিতা হয় নারী। যুদ্ধের কারণে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ, শিশুমৃত্যু। যত আধুনিক হ”েছ মানুষ, যুদ্ধাপরাধও হয়ে উঠছে তত অবশ্যম্ভাবী, সর্বব্যাপী, বীভৎস, যন্ত্রণাদায়ক।
যুদ্ধাপরাধের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনন্য- এত অল্প কালে, এত বেশি পাত্র এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধের শিকার হয়নি সম্ভবত, কোনো স্থানে, কোনো কালে। বাংলাদেশের সব জায়গায় যুদ্ধ হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশের এমন এক ইঞ্চি মাটিও হয়তো নেই, যেখানে যুদ্ধাপরাধ হয়নি। আমরা যারা ‘বাংলাদেশ’ নামক স্থানের উত্তরাধিকারী এবং স্বত্ত্বাধিকারী, তাদেরকে এই রাষ্ট্রের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস যেমন জানতে হবে, তেমনি জানতে হবে, এখানে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস, যাতে এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হতে না পারে।
বধ্যভূমিতে একদিন। সেই আশি সাল থেকে, প্রায় চল্লিশ বছর ধরে মনে মনে পরিকল্পনা করে এবং চার বছর ধরে শুটিং করে কিছুটা সরকারি অনুদানে এবং অনেকটাই নিজের অর্থায়নে দুই ঘণ্টার এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন কাওসার চৌধুরী। এই ছবির বিষয় যুদ্ধাপরাধ, কিন্তু কী আশ্চর্য, এক ফোঁটা রক্ত নেই এই ছবিতে। এমন একটি ছবিতে রক্ত দেখানো লোভ সামলানো সহজ ছিল না পরিচালকের পক্ষে। দুই উপায়ে এখানে দেহের ও মনের রক্তক্ষরণ দেখানো হয়েছে। প্রথমত আছে ভুক্তভোগী পাত্রদের স্মৃতিচারণ, যেগুলো ‘রক্তাক্ত’ বললেও কম বলা হয়। দ্বিতীয়ত, ছবির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রক্তের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে রক্তগোলাপের পাপড়ি।
ছবির নির্মাণ পদ্ধতি অতি সরল। যে সকল স্থানে যুদ্ধাপরাধ সংঘঠিত হয়েছিল, কাওসার চৌধুরীর ক্যামেরা সেই সকল স্থানে গিয়ে যুদ্ধাপরাধের শিকার, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া পাত্রদের মুখোমুখি হয়েছে। ‘ঠিক কী হয়েছিল বলুনতো!’ ভুক্তভোগীদের মনে কথাগুলো জমে আছে দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে। কেউ তাদের কাছে কখনও কিছু জানতে চায়নি। সেই কালের ইতিহাস, কীভাবে দিনের পর দিন হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাঁরা- ভুক্তভোগীরা অবলীলায়, অতি স্বাভাবিকভাবে বলে গেছেন।
৭১ সালে সৈয়দপুর স্টেশনের নিকটবর্তী শহরে ও গ্রামে একদিন মাইকিং করে বলা হলো, রাজাকারের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে যারা ভারতে যাবার চিন্তা করছেন, তাদের জন্যে একটি ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে পাকিস্তান সরকার। সরকারের মিথ্যা প্রচারণায় বিশ্বাস করে হাজার খানেক হিন্দু মাড়োয়ারি নারী-পুরুষ-শিশু উঠে বসে সেই ট্রেনে, সৈয়দপুর স্টেশনে। ধীরে ধীরে চলতে থাকে ট্রেন এবং এসে দাঁড়ায় একটি ব্রিজের উপর। তারপরই শুরু হয় হত্যাকাণ্ড। কিরিচের এক কোপে মাথা উড়িয়ে দেয়া, শিশুদের শরীরকে আড়াআড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলা, দুধের বাচ্চাদের আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়োনেটে গেঁথে ফেলা ইত্যাদি রাজাকারদের নৃশংসতার কয়েকটি মাত্র উদাহরণ।
‘জয়বাংলা’, ‘আওয়ামি লীগ জিন্দাবাদ’ বলে বিহারিরা এগিয়ে আসছিল আমাদের পাড়ার দিকে। কাছে আসতেই তাদের শ্লোগান পালটে গেলো: ‘নারায়ে তাকবির’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। আমার বড় ভাই বাদল, চট্টগ্রাম কলেজে পড়তো, ছাত্রলীগ করতো। ওর মাথাটা কিরিচের এক কোপে কেটে রক্ত ঢেলে দিল তারা আমার মায়ের মাথার উপর। আমার মেঝো ভাইকে বাঁচানোর জন্যে আমি তাকে জড়িয়ে ধরে লুকিয়েছিলাম, খাটের তলায়। পেট্রোলের আগুনে জ্বলে গেলো আমার শরীরের বাম দিক। অজ্ঞান হয়ে গেলাম। ভাইকে কখন টেনে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে আমি জানিও না।’
‘গত ছেচল্লিশ বছর এই পোড়া শরীর নিয়া আছি। আমার সমবয়সীরা কী সুন্দর সংসার কইরতেছে। আমারওতো একটা বিয়া অইতে পাইরতো, কোল জুড়ে বাইচ্চাকাইচ্চা থাকতে পাইরতো। জীবনে আমি কী পাইলাম? আমারটাওতো শরীর। আমারও মনে কি ইচ্ছা থাইকতে পারে না?’ চিরকুমারী খুকুরানীর প্রশ্নের কী জবাব দেবেন আপনি? কী বলবেন, যখন আপনি জানবেন, গত ছেছল্লিশ বছর ধরে কুষ্ঠিয়ার বীরাঙ্গনা বিধবাদের একঘরে করে রাখা হয়েছে? পুকুর থেকে তাদের পানি তুলতে দেওয়া হয় না, দোকানে বাজার করা মানা তাদের। ‘সব হারাইছি আমি, ইজ্জত দিছি, দুঃখ কপালে আছিল, কী কইরবো! তবু বলি দেশের মানুষ ভালো থাক!’ মাথা নিচু করে বলেন এক বীরাঙ্গনা লাইলী বেগম। মাথা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটুকুও নেই, সাহস করতে পারেননি গত প্রায় পাঁচ দশক।
‘বাপের সামনে মেয়েকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করেছে রাজাকারেরা। কিছু করার উপায় ছিল না কারও, চোখ বন্ধ করে রাখা ছাড়া। বললেন চট্টগ্রামের মিরের সরাইয়ের এক প্রত্যক্ষদর্শী। আনোয়ারার এক জেলে-বধু রাশনা বালা জলদাসী বিয়ের একমাস পরেই পাকিস্তানি হানাদারদের ব্রাশফায়ারে চোখের সামনে নিজের স্বামীকে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখেছেন নিজের চোখের সামনে। ‘হাসিনা মামণির কাছে আঁই কিছু ন চাই। আঁরা অশিক্ষিত, গরীব মানুষ, কথা কইত ন জানি। জীবনত কিছু ন পাই!’ তঅ কইরদে (তবুও বলছি), ‘আঁরা যে বাঁচি আছি, হাজার শোকর।’
এ ছবি দেখে দর্শক, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হোন কিংবা বিপক্ষে, এমনকি স্বয়ং যুদ্ধাপরাধীও যদি তিনি হয়ে থাকেন, অশ্রুভারাক্রান্ত না হয়ে পারবেন না। তার মনে নিশ্চয়ই এ প্রশ্নের উদয় হবে: রক্তমাংসের একজন মানুষ কীভাবে আরেক জন নিরপরাধ মানুষকে এত নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে, শ্রেফ সে অন্য ধর্মের, অন্য দলের, অন্য মতাদর্শের অনুসারী বলে? জীবন্ত অবস্থায় বুক চিয়ে হৃদপিণ্ড বের করে আনা, গায়ের চামড়া তুলে নিয়ে মাছ কাটার মতো মানুষের শরীরকে খণ্ড-বিখণ্ড করে পাতকূয়ার মধ্যে ফেলে দেওয়া, ব্লাস্ট ফার্নেসে জীবন্ত মানুষকে জ্বালিয়ে দেওয়া, বস্তায় ভরে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া- এই সব অপরাধ সংঘঠিত করেছে একাত্তরের রাজাকার, আলবদর আল শামস এবং তাদের দোসর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
ছেচল্লিশ বছর পর একটি মৃত্যুকূপ খননের খবর পেয়ে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন কাওসার চৌধুরী। কূপ থেকে উঠে আসছিল হাড়গোড়, মাথার খুলি। কূপের পাশে দাঁড়িয়ে এক বর্তমান প্রজন্মের এক সাংবাদিক বললেন: ‘যুদ্ধাপরাধীদের মনে কিন্তু বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। একাত্তরের কৃত অপরাধের জন্যে গত পাঁচ দশকে একবারও ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি অভিযুক্ত দলগুলো কিংবা পাকিস্তানের শাসকেরা। যুদ্ধাপরাধের কথা স্বীকারই করে না তারা। ‘আরেক বার যদি ওরা সুযোগ পায়, তবে বাঙালির মৃতদেহ তারা আর কোনো কূপে ফেলবে না। পঞ্চাশ-একশ বছর পর যাতে ওদের অপরাধের কোনো প্রমাণ খুঁজে না পাওয়া যায়, সে লক্ষ্যে মৃতদেহ পুড়িয়ে তারা ছাই করে দেবে, এ্যাসিডে গলিয়ে ফেলবে, যেমনটা করেছে আল শামসের গুণ্ডারা, ১৯৭১ সালে!’
দ্বিতীয়বার যদি আমরা ভুল করি, তবে সে ভুলের মাশুল দেওয়া অনেক কঠিন হবে- এটাই আমার মতে কাওসার চৌধুরীর ‘বধ্যভূমিতে একদিন’ ছবির অন্যতম শিক্ষা। আপনি চুপ করে থাকলেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষ চুপ করে বসে থাকবে না, চুপ করে বসে নেই। সামাজিক-অসামাজিক সব গণমাধ্যমে ওরা সতত সক্রিয়, রাজনীতি-অর্থনীতি সব সেক্টরে সমান সক্রিয়। সুতরাং আমি মনে করি, কথা যেখানে বলতে হবে, সেখানে চুপ করে থাকা দায়িত্বে অবহেলার সামিল। কাওসার চৌধুরী নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনিও কেন আপনার দায়িত্ব পালন করেন না, অন্ততপক্ষে মুক্তিযুদ্ধে নিজের নিজের বিশ্বাসটুকু অটুট রেখে?
বলা হয়ে থাকে যে একটি ছবি হাজার কথার চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু কথা ঠিকঠাকমতো শক্তিশালী হলে ছবিও যে আর অপরিহার্য থাকে না, এই সত্যটি বুঝতে হলে ‘বধ্যভূমিতে একদিন’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্রটি অন্তত একবার দেখতে হবে। আমার মতো একাধিক বার দেখলেতো কথাই নেই। মুক্তিযুদ্ধকে নিছক ‘গণ্ডগোলের বছর’ বলে যাঁরা পার পেতে চান, তাদেরকে দুবার ভাবতে ভাবতে বাধ্য করবে এই প্রামাণ্যচিত্র।
লেখক : সাবেক পরিচালক- আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহকার সমস্যা সমাধানে নগর পিতার অভিভাবকের ভূমিকা চাই
পরবর্তী নিবন্ধবিজয় ২০২১ এবং সাফল্যের গৌরবগাথা