“সাহিত্যে চুরি, চুরি নয়”। এই ভ্রান্তির মধ্যে এখন আমাদের বসবাস। এর ভেতর দিয়েই বলতে হয় থিয়েটারের দৃশ্যাবলীতে গত কয়েক দশক ধরে বিষয়বস্তুর অতি প্রাচুর্যতা তার নান্দনিক সঙ্গতি ও উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে নাটকের প্রথাগত কাঠামো থিয়েটারকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে বর্তমান কোনো কোনো পণ্ডিতগণ মনে করছেন। “বিশ্বের বাতাসে এখন নর্দমার জলের নোংরা টক–টক গন্ধ। আমরা সকলেই এখন নর্দমার মধ্যে এবং এই নর্দমার ভেতর থেকেই কেউ কেউ আকাশের তারা দেখতে পায়।” বর্তমানে এই নতুন বিষয় নিয়ে কথা বলাটাই (বিশ্ব)-শিল্প, সাহিত্য ও থিয়েটারের মানুষদের জন্য অতীব জরুরি। বিষয়টি খুঁজে দেখা, সনাতন ও প্রাচীনের মধ্য থেকে নতুনকে আবিষ্কার করার লক্ষ্যে, অসাম্প্রদায়িক চাদরের ভাঁজে ভাঁজে। এটা নতুনের সৃষ্টির খোঁজে একটা পরিবর্তনের পুনঃপ্রকাশ।
একজন থিয়েটারের নির্দেশকের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয়; যেকোনো ধরনের সমকালীন পরিবেশনাকে ধারণ করতে হয় নীরিক্ষার প্রচুরসংখ্যক বৈচিত্র্যের ভিন্ন ভিন্ন অর্থকে সঙ্গে নিয়ে। নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে কেউ কেউ একমত হবেন আবার নাও হতে পারেন, সেটা হচ্ছে, থিয়েটার বা (পারফরম্যান্স)-এর মধ্যে “নতুন দৃষ্টান্ত–ই এর ‘বতর্মান’ কাল।” এই বর্তমানকে ধরতে যেয়ে ১৯৪২ সালেই মুনীর চৌধুরী জানান দিলেন “আসুন চুরি করি”। একটা ঝড়। যে ঝড়টা ধরে রাখতেই আমার আজকের আলোচনার শিরোনাম নির্ধারণ করলাম “আসুন চুরি করি”। নামটা ধার করা না। প্রফেসর, তাত্ত্বিক, নাট্যকার স্যার মুনীর চৌধুরীর কাছ থেকে মেরে দেওয়া। অর্থাৎ চুরি করা। এইরকম চুরিবিদ্যাটা স্যারের কাছ থেকে পাওয়া; “… চুরি করার জন্যে আমাদের প্রত্যেককে গড়ে তুলতে হবে… আসুন, দেরী না করে… এ কথাটা মনে রাখবেন, যাঁরা চুরি করেন সাধারণত তাঁরা যারা চুরি করে না তাদের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান।” টি এস এলিয়ট এই প্রসঙ্গে জোরালোভাবে যে কথাটি বললেন সেটা হচ্ছে: “অপরিণত কবিরা অনুকরণ করেন; পরিণত কবিরা চুরি করেন; খারাপ কবিরা যা নেয় তা নষ্ট করে; আর ভালো কবিরা সেটাকে আরও ভালো কিছু বা অন্যকিছুতে পরিণত করে। ভালো কবি তার চুরিকে এমন একটা অনুভূতিতে ঢেলে দেন যেটি অনন্য, যা অন্যটার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন; এটি হচ্ছে সৃজনের কাজ।” সৃজনের সন্ধান, একটা নতুন সৃষ্টি। পাবলো পিকাসো সৃজনের এই গোপন সত্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বললেন: “ভালো” শিল্পী এবং “মহান” শিল্পীরা খুব আলাদাভাবে কাজ করেন। একজন “ভালো” শিল্পী অন্য শিল্পীর স্টাইল দেখতে পাবেন এবং তারপর সেই শৈলীটিকে যতটা ঘনিষ্ঠভাবে করতে পারেন তার অনুকরণের চেষ্টা করেন। আর একজন “মহান” শিল্পী অন্য শিল্পীর কাজ থেকে উপাদান নির্বাচন করে এটিকে অন্য একটি মিশ্রণে রপান্তরিত করে। এই মিশ্রণ প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে “ইন্টারটেক্সচুয়ালটি” বা “আন্তঃপাঠ্য”। যা যুক্ত হয়ে আছে “নিওলজিজম (ঘবড়ষড়মরংস)” ধারণার সাথে। যেটা স্যার মুনীর চৌধুরীর কাজের একটা বড় ক্ষেত্র। বিশেষ করে তাঁর নাটকের ফর্ম, সংলাপ, পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে নাট্যভূমির সন্ধিক্ষণ ইত্যাদি। যার বসবাস ‘Alternative Modernity’–এর মধ্যে।
খোলা চোখে “ইন্টারটেক্সচুয়ালটি” বা “আন্তঃপাঠ্য” অর্থ বুঝতে একটা পাঠ্য থেকে অন্য পাঠ্যের প্রতি ইঙ্গিত করার ঘটনাকে বোঝায়। এটি ভিন্ন পাঠ্যের মধ্যে আন্তঃপ্রক্রিয়া এবং আন্তঃসংযুক্ততার একটা খেলা, যেখানে একটি পাঠ্যের অর্থ অন্য পাঠ্যের সাথে এর সম্পর্ক দ্বারা “আকৃতি” বা “ফর্মকে নির্ধারণ করে। যার মধ্যে লুকানো থাকে নানা উদ্ধৃতি, ইঙ্গিত, ক্যালকুস, চুরি, প্যাস্টিচ বা প্যারোডি নামের ছলচাতুরি। যে ছলচাতুরীর মধ্যেই সৃজনের বসবাস। যার প্রকাশ সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প ও সাহিত্যে ছড়ানো–ছিটানো ভাবে, সেটা যেমন পূর্বে তেমনি পশ্চিমে, আবার উত্তর–দক্ষিণেও একই চেহারা। যেটা যুক্ত হয়ে আছে ‘আধুনিকতা(বাদ)-র সাথে। যার লক্ষ্যই হচ্ছে সমকালীন ও সমকালীনতার খোঁজ করা। এই বিষয়ে স্যার মুনীর চৌধুরীর মত “…এ–যুগের মূলমন্ত্র মেনে আমরাও সেই উদারচেতা সাহিত্যিকদের বিদেশি জুতোর অনুসরণ করি: তাঁদের যারা চুরি করেও চোর নন।” একারণেই সম্ভবত বার্থস (Bearthes) লেখককে হত্যা করেছেন। আর ফুকো (Foucault) লেখককে একজন মৃত মানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ করাতে চেয়েছেন।
ধরা যাক ‘লেখকের মৃত্যু’ একটি সাহিত্য তত্ত্ব; এটা যুক্তি দেয় যে একটি পাঠ্যের অর্থ লেখকের উদ্দেশ্য দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং পাঠকের ব্যাখ্যা দ্বারা নির্ধারিত হয়। এটা একটা পারস্পরিক সূত্রের দ্বান্দ্বিকতা। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হচ্ছে এই অংশে আমাদেরকে দুটি অবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে বিভিন্ন টেক্সটের একত্রীকরণের প্রক্রিয়াটা বুঝতে হবে। চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে হবে সমকালীন থিয়েটার এবং পারফরম্যান্সের চর্চার মানচিত্রের বিন্দুগুলোকে। এবং এই বিষয়গুলো সমকালীন পরিস্থিতিতে কেমন করে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, সেটা পুনঃঅনুসন্ধান করার পথ বের করা। যে অনুসন্ধানের কেন্দ্রে রয়েছে একটি শিল্প বা সাহিত্য কিংবা পারফরম্যান্সের নানা বর্ণের কাঠামোর একটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবয়বের মুখোশ– সমকালীন, ইন্টার–টেক্সটুয়ালিটি, উত্তরাধুনিকতা, উত্তরাধুনিক এবং উত্তরনাট্যকৌশল ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে আন্তঃপাঠ্যতার ধারণা আন্তঃবিষয়িকতার ধারণাকে প্রতিস্থাপন করে। যেটার বিস্তৃতি পাওয়া যায় জোহান উলফগ্যাং গোয়েটের “বিশ্ব সাহিত্য” আলোচনা বিষয়ে (Johann Wolfgang Goethe’s ‘World literature’): “জাতীয় সাহিত্যের আজকাল খুব বেশি অর্থ নেই। এটা বিশ্বসাহিত্যের যুগ…।” যে কারণে আমরা বলতে পারি আন্তঃপাঠ্যতা হলো একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক গতিবিদ্যা। যে গতিবিদ্যা চালিত হয় কখনো ‘বাধ্যতামূলক’ ভাবে, কখনো ‘ঐচ্ছিক’ আবার কখনোবা ‘দুর্ঘটনাজনিত’ কারণে। রোল্যান্ড বার্থস’র (Roland Barthes) ভাষায়, “উদ্ধৃতি চিহ্ন ছাড়া উদ্ধৃতি”। এই ঘটনাটা বংলার শিল্পী–সাহিত্যিকরা অনেকেই ঘটিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ তো বটেই। যেমন ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক “রাজা”। যেখানে হঠাৎ করেই ঢুকে পড়লো শেকস্পিয়রের “হ্যামলেট”, কোনো উদ্ধৃতিচিহ্ন ছাড়াই। আমার মনে হচ্ছে বিষয়টি আরো খুলে বলা দরকার। ধরা যাক “রাজা” নাটকের প্রথম অংশ:
“সুরঙ্গমা : বড়ো দরজাটা খুলেছে– তিনি আসছেন, ভিতরে আসছেন।
সুদর্শনা : তুই কেমন করে টের পাস?
সুরঙ্গমা : কী জানি মা। আমার মনে হয় আমার বুকের ভিতরে পায়ের শব্দ পাচ্ছি…।”
এবার দেখা যাক শেকস্পিয়রের “হ্যামলেট” নাটকের অবস্থান রবিঠাকুরের ‘রাজা’র পাশাপাশি:
“Hamlet : …My father, methinks I see my father.
Horatio : O, where, my lord?
Hamlet : In my mind’s eye, Horatio.”
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে দুটো নাটকের এই স্থানটির অবস্থা, ক্রিয়ারেখা, দ্বান্দ্বিকতা এবং চরিত্রের শ্রেণিগত অবস্থান একইরকম। দুটো নাটকের কাঠামোই মনুমেন্টাল এবং “চিয়ারোস্কোরো (Chiaroscuro)’ অর্থাৎ উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল বর্ণের সমাবেশ। শুধুমাত্র রবি ঠাকুর ‘Hamlet’ নাটকের Hamlet চরিত্রের মুখের সংলাপ দিয়ে দিলেন ‘রাজা’ নাটকের সুরঙ্গমার মুখে, আর Horatio চরিত্রের সংলাপ তুলে দিলেন সুদর্শনার মুখে। এটা একটা মজার খেলা। যে খেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে “ম্যাজিক ইফ”। সময় ও স্থানের ভেতরের অনুষঙ্গের রূপান্তর প্রক্রিয়া। এই ধারার টেক্সটগুলি বিস্তৃতির বিশাল এক মোজাইক। যেটা একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক, তেমনি অন্যদিকে আন্তঃবিরোধী, এবং আন্তঃবিষয়ক হাইপারটেক্সচুয়াল। যে–কারণে এটা একটা নতুনের সৃষ্টির ‘বিনির্মাণ’ প্রক্রিয়া। যা সংযুক্ত থাকে প্রসঙ্গ এবং এর প্রাসঙ্গিকতার সাথে। এটা একটি জটিল নেটওয়ার্ক প্রক্রিয়া বলেই উত্তরাধুনিকতার সাথে আন্তঃপাঠ্যতা জড়িত। এইরকম একটা “বিনির্মাণ” প্রক্রিয়ার আধার স্যার মুনীর চৌধুরীর “কবর” নাটক। যার ভেতরে আলো–আঁধারির রহস্যময় পরিবেশের ছায়া হয়ে আছে আরউইন শ’র “বেরি দ্য ডেড” নাটকটি। নাটকটি এগিয়ে যায় একটা অন্য আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গের ভেতর দিয়ে। যে আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গটি একান্তই আমাদের। যে জন্যে এর ভেতর খুঁজে পাওয়া যায় এক ধরনের “প্যারালালোগ্রাম”, যেটা সামন্তরীক হবার ফলে দুটো নাটকই হয়ে ওঠেছে একই ধারার রাজনৈতিক প্রহসন। একটি বিশেষ অবস্থার মধ্যে সময়ের “শিল্পগত রূপায়ণ”। “কবর” নাটকটিতে যুক্ত হয়ে আছে বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রাম, ভাষায় দাবী, শ্রেণিবিদ্বেষ, বৈষম্য, বাঙালির মুক্তি এবং আরো অনেক কিছু। এতোকিছু হয়ে ওঠার কারণে আমি মনে করি, “কবর” বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা রাজনৈতিক Testimony অথবা বলা যায় রাষ্ট্রের ইতিহাসের “এপিগ্রাফ”। এই যুক্তির সমর্থনে মনে পড়লো রাজনৈতিক দার্শনিক মুনীর চৌধুরীর কথা: “শুধুমাত্র কবর নাটকটিতে একুশের তাৎপর্য খোঁজা হলে খানিকটা ভুলই বরং করা হবে। হয়তো আরো বেশি কিছু বলার চেষ্টা করেছি আমি…।” এটা যে রাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক প্রহসনের “এপিগ্রাফ” সেটার প্রমাণ নাটকটি লেখার সময়কাল ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। সময়টা ১৯৫৩। স্থান, ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার। যেটা পাকিস্তানি শাসকদের তৈরিকৃত ঔপনিবেশিক কারাগারের একটি সামন্তরিক রেখা, জাতির সকল রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা তখন ঐ কেন্দ্রীয় কারাগারে। “অনেকেই… আবুল হাশিম, মোজাফফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অজিত গুহ, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, শেখ মুজিবুর রহমান” সহ অনেকেই। কথিত আছে এদের মধ্যে কেউ কেউ এই নাটকের প্রথম রজনীর দর্শকও ছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত (দাদা)ও তখন রাজবন্দী। বাড়িঘর জেলখানায়। ঠাঁই হয়েছিল স্যার মুনীর চৌধুরীর কয়েদখানার পাশেই। “কবর” নাটক লেখার সূত্র সেখানেই: “রণেশদাই গোপনে চিঠি লিখেছিলেন আমাকে”। জেলখানায় নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। কতগুলো হারিকেনের আলোয়। জেলের বন্দীরা যারা সে–রাতের দর্শক ছিলেন বিশেষভাবে রাজবন্দীদের কাছে নাটকটি হয়ে উঠলো নতুন জাগরণের রাজনৈতিক কবিতা । পাকিস্তান শাসকের ঐরকম একটা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ওটা কপি হয়ে কারাগারের বাইরে চলে গেল। প্রথমে দৈনিক সংবাদ–এ এবং পরবর্তীতে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হলো। নাটকটি হয়ে উঠলো একটি জাতির বন্দিজীবনের রাজনৈতিক রোজনামচা। যার মূলে পরাশাসন এবং বিচ্ছিন্নতা। নাটকটির সাথে আমেরিকান নাট্যকার আরউইন শ’র নাটক “বেরি দ্য ডেড(১৯৩৬)”-এর মিশ্রণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বললেন: “ও হ্যাঁ, বেরি দ্য ডেড” সে–সময়েই নাটকটি পড়ি আমি। তাতে মৃত ব্যক্তির প্রতিবাদ ছিল, সে যে কবরস্থ হতে চায় না, তার চিৎকার ছিল।” যে “চিৎকার” হয়ে ওঠে স্যার মুনীর চৌধুরীর নাটকের জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়। আর নাটকের ফর্মটা যুক্ত হয়ে পড়ে আন্তঃপাঠ্য প্রক্রিয়ার কৌশলের সঙ্গে:
“দেখবেন এক, তবু মনে হবে দু’। অথবা দেখবেন দু’ তবু মনে হবে এক।”