একজন ভগ্নিপতি তার নবপরিনীতা স্ত্রীর নাবালিকা বোনকে শিকার হিসেবে তুলে দেয় মাঝবয়সী পিতার মুখে। বাঘের থাবায়, দংশনে হরিণ শাবক বিধ্বস্ত মৃতপ্রায়। অতঃপর ধর্ষককে বাঁচাতে এগিয়ে আসে স্ত্রী– পুত্র। নির্যাতিত শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় তারা। ঘটনার মোড় ঘোরাতে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় শিশুটিকে। গণমাধ্যমের দৌড়ঝাঁপে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। একে একে জেলা সদর, রাজধানী হয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয় অচেতন শিশুটি।
বড় কপাল করে এসেছিল মেয়েটি! দেশের সেরা হাসপাতালে সেরা চিকিৎসকদের কাছ থেকে সেরা চিকিৎসা লাভ করেছে সে। মাগুরা জেলায় সাত জনমে কেউ দেখেছে এসব! হাসপাতালের এলাহি কাণ্ড দেখে চোখ ছানাবড়া হতদরিদ্র মায়ের। কিন্তু মেয়েটিকে বাঁচানো যায়না। আত্মীয়ের বাড়ীতে সেই ভয়াল রাত্রিতে তাকে হত্যা করার জন্য কতো না আয়োজন ছিল। আট বছরের মেয়েটি তখন মরেনি। আবার হাসপাতালে ছিল তাকে বাঁচানোর আয়োজন। তখন সে আর বাঁচেনি। জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শিশুটির নীরব লড়াই চলেছিল সপ্তাহব্যাপী।
দেশজুড়ে নিন্দার ঝড়; নগরে নগরে, বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের সম্মুখ সারিতে যথারীতি মেয়েরাই আছে। প্রতিটি বিক্ষোভ সমাবেশে পুরুষের উপস্থিতি হাতে গোনা। উপরন্ত ধর্ষণবিরোধী পদযাত্রায় চড়াও হয় পুলিশ। পতিত স্বৈরশাসনামলের মতোই রাজপথে তরুণীর চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে পৌরুষের সাক্ষ্য দেয় আইনের কর্মী। রমযান মাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও রমযানের পবিত্রতা ভঙ্গ করার অপরাধে বেধড়ক পিটুনি দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের। কিন্তু দেশজুড়ে চলমান ধর্ষণের মহোৎসব বন্ধ করার কোন কার্যকরী পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয় না। বরাবরের মতো আশার বাণী আওড়েই দায়িত্ব সমাধা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিগণ।
এতোকালের অভিজ্ঞতা বলে– যে সমাজে ধর্ষককে রক্ষা করার জন্য আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে বেড়ান বিজ্ঞ আইনজীবীগণ, ধর্ষণবিরোধী মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের লাঠি সক্রিয়, সে সমাজে ধর্ষকামিতার বিস্তার ঘটবে নানা রূপে নানা মাত্রায়– এটাইতো স্বাভাবিক। মাগুরার শিশুটির কথা ভুলে যেতে আমাদের দুদিনও লাগবেনা। চট্টগ্রামের জামালখানের মারজানা হক বর্ষা নামে প্রথম শ্রেণীর সেই ছাত্রী, যে মোড়ের দোকান থেকে চিপস কিনতে গিয়ে আর ঘরে ফিরে আসেনি, তার কথা কি আমরা মনে রেখেছি? তিন তিনটি বছর ধরে আইনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন অভাগিনী মা। অপরাধী সনাক্ত হয়েছে, নিজ মুখে অপরাধ স্বীকার করেছে। অন্ধ আইন তথাপিও পথ দেখেছে না। এক পাও এগোয়নি মামলার গতি।
ইয়াসমিন, সীমা, তনুসহ বিচারহীনতার শত সহস্র উদাহরণ আইনের অকার্যকারিতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে যুগে যুগে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, গত দশ বছরে পাঁচ হাজার ছয়শ’র বেশী শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যা আমাদের সমাজে ক্রমবর্ধমান পাশবিক কদর্যতার সাক্ষ্য বহন করছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পতাকাধারী সমাজের উঁচু তলার নাগরিকদের অনেকেই গা বাঁচিয়ে চলছেন। মানবিকতা, ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠায় তাদের অস্বাভাবিক নীরবতা ক্রমাগত খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে সমাজটাকে। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় ধর্ষকের তালিকা। কিশোর যুবা প্রৌঢ় বৃদ্ধ কেউ যেন আর পিছিয়ে থাকতে চায়না। আসিয়া যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল, তখনও দেশের নানা স্থান থেকে ধর্ষণের খবর আসছিল। এখনও আসছে। প্রতিদিনই আসছে। ঠিক যেন চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন– আর ধর্ষকের ৩৬৫ দিন।
আসিয়ার মৃত্যুর ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি সাধারণ ভাবনায় নাড়া দেয় তা হলো– আসিয়ার পরিবারকে নিয়ে এক নিদারুণ খেলায় মেতেছে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ। গণমাধ্যমে নির্যাতিতের পরিবারের সঙ্গে সংবাদকর্মীদের প্রায়শই আপত্তিকর আচরণ করতে দেখা যায়। সাক্ষাৎদাতার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার কোন ধার ধারেননা অধিকাংশ সাংবাদিক। এটা কি শুধু আসিয়াদের আর্থ–সামাজিক অবস্থানের জন্যই? বলা নেই কওয়া নেই, অনুমতির বালাই নেই, ক্যামেরা কিংবা একটা মুঠোফোন হাতে নিয়ে যে কেউ যখন খুশি ভুক্তভোগীর ঘরে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, জেরাও করতে পারে। তাদের বক্তব্য মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে অন্তর্জালে। প্রতিটি নাগরিকই তখন একেক জন বিচারক বনে যান। আসিয়ার বড় বোনকে কোন এক সংবাদকর্মী প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করে তুলছিল, কেন সে একেকবার একেক কথা বলছিল। আসিয়ার বড় বোনটি বিবাহিত হলেও সে কিন্তু একজন শিশুই, বড় জোর কিশোরী বলা যেতে পারে। উপুর্যুপরি প্রশ্নের আঘাতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে মেয়েটি। তার ওপর দিয়েওতো কম ঝড় বয়ে যায়নি! অপ্রাপ্তবয়সী কন্যাকে বিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনের অপরাধে আসিয়ার মাকেওতো তাহলে বন্দি করা যেতে পারে। রাষ্ট্র কি পারবে আসিয়াদের মায়েদেরকে এমন নিশ্চয়তা দিতে যখন তারা মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য অপেক্ষা করবেন?
আরেক অতি উৎসাহী সংবাদকর্মী আসিয়ার এক ছেলে সহপাঠীর সঙ্গে বেশ হাসি হাসি মুখ করে কথা বলছিলেন। তার কথা শুনে মনে হবে আসিয়া এখন এক বড় ‘সেলিব্রেটি’। আসিয়ার বন্ধুর কাছ থেকে তিনি জানতে চান– সে পড়ালেখায় কেমন ছিল, তারা কিভাবে খেলাধুলো করতো। আসিয়াকে নিয়ে সেই বালকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কি কোন প্রয়োজন ছিল? টেলিভিশনে প্রচারিত সাক্ষাৎকার এই শিশুটির মনোজগতে কি প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে সংবাদকর্মী ভেবে দেখছেন কি? আসিয়াদের বাড়ীতে সংবাদকর্মীদের অবাধ যাতায়াত ন্যায়বিচারের পথে কতটুকু সহায়ক হবে, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
উপরন্তু রাজনৈতিক কর্মীগণ অবতীর্ন হয়েছেন যথারীতি ত্রাণকর্তার ভূমিকায়। আসিয়াদের বাড়িতে নামজাদা নেতৃবগের্র পদধুলি ও টেলিভিশন কাভারেজ এবং সেই সঙ্গে অযাচিত মানবিক সাহায্য মনে করিয়ে দেয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতিতে ‘মৃত আসিয়া’ একটা বড় উপাদান বা ফ্যক্টরে পরিণত হতে চলেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে নিজেদের অপরিহার্যতার সাক্ষ্য দেওয়ার মোক্ষম উপায় এখন আসিয়ার বাবার পর্নকুটির পরিদর্শন। আসিয়াদের আঙিনায় গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক কর্মীদের উপচে পড়া ভিড় জাতি হিসেবে আমাদের বোধশক্তি লোপের সাক্ষ্য বহন করছে।
কে বলবে মাস সাতেক আগে কি ভয়াবহ দুর্যোগ পাড়ি দিয়েছিল বাংলাদেশ ! সমাজে বসবাসরত বর্ণচোরাদের রঙ বদলের এই খেলার বুঝি শেষ নেই এই মাটিতে। কেবলমাত্র দেয়ালের ছবিগুলো বদলানোর জন্যই কি সহস্রাধিক যুবক বুকের রক্তে রাজপথ ভিজিয়েছিল? আমরা কি আসলেই দেশটাকে বদলাতে চাই? জনজীবনে স্বস্তি আর শান্তি চাই? আইনের মারপ্যাঁচ কষে অপরাধীকে নির্দোষ প্রমাণের সেই প্রথা কি আজও বহাল থাকবে? বদলে যাওয়া বাংলাদেশে আইন কি এবার চোখ মেলে তাকাবেনা? অন্তত তিন দশক আগে কথাশিল্পী ফেরদৌস আরা আলীম তাঁর ‘কোথাও নতুন দিন’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, -“আইন আছে অথচ শাস্তি হবেনা সেক্ষেত্রে অপরাধ বাড়তে বাধ্য। আর সে আইন যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহলেতো অপরাধীর পোয়াবারো”। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়ে তাঁর কলমে, “বিচার প্রক্রিয়ার স্তরে স্তরে ফসিল হয়ে যায় কত চার্জশীট !” ‘প্লাবনের মতো, মহামারীর মতো ধেয়ে আসা’ মানবিক বিকৃতির হাত থেকে আমাদের মেয়েদের রক্ষার জন্য ‘আরেকটি মরণজয়ী যুদ্ধে’র ডাক দিয়েছিলেন লেখক। তিনি আশায় ছিলেন আগামী দিনের কোন লেখককে হয়তো এ নিয়ে আর কলম ধরতে হবেনা। কিন্তু একুশ শতকের উন্নতি ও প্রগতির কালে আমাদের যাবতীয় অগ্রগতি যে অন্তঃসারশুন্য আস্ফালন বৈ অন্য কিছু নয়, মাগুড়ার শিশুটি তা–ই আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল।
আসিয়ার শোকে মুহ্যমান এখন জাতি। সত্যি কি তাই? একবার ভেবে দেখুনতো পাঠক। তেরই মার্চ দুপুর একটায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক যদি আসিয়াকে মৃত ঘোষণা না করতেন, যদি বলতেন ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পাচ্ছে আসিয়া। এরপর উন্নত ও নিবিড় চিকিৎসা সেবায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেত শিশুটি। আমরা কি বাঁচতে দিতাম মেয়েটিকে? আত্মীয় পরিজন, পাড়া প্রতিবেশী, সমাজ, গণমাধ্যম, সর্বোপরি আইন আদালত ও রাষ্ট্র কি তার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলতোনা? এক পর্যায়ে হয়তো তার মা–ই বলতেন, কেন সেদিন মরে গেলিনা পোড়ামুখী? কেন বেঁচে ফিরে এলি আমার গলার কাঁটা হয়ে? কিন্তু ধর্ষক অনায়াসেই পুনর্বাসিত হয়ে যায় সমাজে। হাজত প্রাঙ্গণে, আদালতের আঙিনায় মিষ্টিমুখ করিয়ে ধর্ষকের বিয়ে দেওয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে আমাদের সমাজে। আগামীতে হবেনা –তা বলার মতো সময় আর পরিবেশ আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি।
নিষ্ঠুরতম সত্যটি হলো এই – মাগুড়ার শিশুটি মরে গিয়েই বেঁচেছে, বাঁচিয়ে দিয়েছে তার মা কে। আর কোন ঈদে নতুন জামার জন্য বায়না ধরবেনা মেয়ে। বাড়ীতে খাওয়ার মুখও একটি কমে গেল। দুর্মূল্যের বাজারে এ যে এক বড় সাশ্রয়! মরে গিয়ে শিশুটি প্রমাণ করেছে এই পৃথিবীতে সেও জন্মেছিল একদিন। দীনহীন পিতামাতার ঘরে অনেকটা অনাহুতের মতো জন্ম নেওয়া কন্যা শিশুটির আগমনের তিথীতে কোন জন্মোৎসব হয়নি। কিন্তু তার মৃত্যু কাঁপিয়ে দিয়েছে পুরো দেশকে, কাঁদিয়েছে দেশের মানুষকে, অবশ্য আমরা যদি প্রকৃতই ‘ মানুষ’ হয়ে থাকি।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়