আসন্ন নির্বাচনে পরিবেশে বিপন্নতা

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি | মঙ্গলবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২১ at ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করেছে আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে। এই ৫০ বছরে দেশের এগিয়ে চলায়, পথ পরিক্রমায় বৈপরীত্য আছে, বৈচিত্র্য আছে, বহুমাত্রিকতা আছে। মৌলিক চেতনার বিভ্রান্তি আছে, বিপর্যয় আছে। যে চেতনা এবং ত্যাগ-তিতিক্ষাকে সঙ্গী করে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ঘটেছিল। তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিপর্যয় ঘটেছিল- তা এদেশের মানুষ ভুলে নাই। তারুণ্যের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ, জীবন বিসর্জন ও রক্ত প্রবাহের কাহিনীগুলো অশ্রুত, অব্যক্ত থাকলেও সার্বিকতায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের মহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ায় বিভ্রান্তি আছে, বিলাস আছে। তারপরও চেতনা হারিয়ে যায়নি। চেতনা আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা, উৎসাহ, উদ্দীপনা।
দেশে দেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের জীবনবোধে, মানবিকতায়, পারস্পরিক সহমর্মিতায় পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে সংবেদনশীলতা, সহনশীলতা, বোধ ও জাগরণে। পৃথিবীর পরিবর্তনশীল মানুষও এই পরিবর্তন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। অত্যাধুনিকতা ডিজিটালাইজড হয়েছে। আইটি সম্পৃক্ত, সমৃদ্ধ হয়েছে। মানুষের আচারিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড ডিজিটালাইজড হয়েছে। আইটি নির্ভর হয়েছে। সমাজে, সামাজিকতায় পরিবর্তন এসেছে। তারুণ্যে বৈশ্বিক চেতনা আঞ্চলিক চেতনাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। বিশ্ব ভাবনায় দেশীয় ভাবনা, দেশাত্মবোধ আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী ডিজিটালাইজড এবং নেট সম্পৃক্ত গ্রামে পরিণত হচ্ছে। পৃথিবী এবং জ্ঞান ভাণ্ডার হাতের মুঠোয় নিয়ে আজকের তারুণ্য সমাজকে, প্রতিবেশকে, পারিপার্শ্বিকতাকে দেখার সুযোগ পাচ্ছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। অস্বাভাবিক নয়, অবাঞ্চিত নয়। সময়ের প্রাপ্তি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তারুণ্যকে শক্তি দিচ্ছে, বিশ্বকে জানান দিচ্ছে। বিশ্বজয়ের’ এমন একটি আকাঙ্ক্ষা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, স্বপ্নের সুবাসে সুশোভিত ছিল। আমরা যতই বিকশিত হচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ততই উজ্জ্বল হচ্ছে।
অপরাপর বিশ্বের দেশগুলোর সাথে তুলনামূলক যাত্রায় আমাদের আরো সচেতন, আরো যত্নশীল হওয়া দরকার। সময়ের প্রত্যয় ও প্রবাহকে সময় মতোই ধারণ করা দরকার।
আসা যাক সিটি কর্পোরেশনের আসন্ন নির্বাচনের কথায়। কিছুদিন আগে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বহুমাত্রিক বিপর্যয়, বিতর্ক, অসন্তোষ থাকলেও পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি। নির্বাচন এলেই কতিপয় সংকট বিস্তৃত হয়। এগুলি সমাজকে, পরিবেশকে, প্রতিবেশকে ছাপিয়ে যায়।
বাংলাদেশর নির্বাচন প্রচারে এখনো পোস্টার-ব্যানার, লেমিনেটেড প্রচারপত্র এবং অপচনশীল ফেস্টুন, ব্যানারে ছাপিয়ে যায় পারিপার্শ্বিকতা। মাইকের শ্রবণকটু শব্দ, মিছিল, মিটিং, জনসভা,পথসভা, স্লোগান সাত মিলিয়ন মানুষের বিরক্তিকে ছাপিয়ে ধারাবাহিক বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। বিজ্ঞান, আইটি কিংবা ডিজিটাল প্রক্রিয়া বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোকে এখনো জয় করতে পারেনি। শহর, নগর, পৌরসভাগুলো লেমিনেটেড পোস্টারে ছেয়ে যায়। শব্দ দূষণ মাত্রা ছাড়িয়ে গগনচুম্বী হয়। মানুষের বিবেক, বোধ থেমে যায় প্রার্থীদের প্রচারণায়।
গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পোস্টার লেমিনেট করার ব্যাপক সংস্কৃতি ছিল ঢাকার নির্বাচনগুলোতে। সুখের বিষয় চট্টগ্রাম মহানগরের আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এই বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়নি। প্রার্থীদের পোস্টার এখন পর্যন্ত লেমিনেট করার অসুস্থ প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত আছে। অত্যন্ত সুখকর কথা এটি। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আবর্জনার সৃষ্টি হয়। মানুষের বিড়ম্বনা বেড়ে যায়। মানুষকে সুখের প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে বিড়ম্বনার জীবন ও প্রতিবেশ উপহার দেয়া হয়। এটি আর যাই হোক, আধুনিকতার লক্ষণ নয়। ভদ্রতার পরিচয় বহনকারীও নয়।
নির্বাচনে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তার সাথে প্রচার-প্রচারণার সম্পর্ক টানলে বৈপরীত্যের চিত্র পাওয়া যায়। এ অবস্থাকে ধীরে ধীরে মানুষ আজ না হলেও কাল প্রত্যাখ্যান করবে।
চট্টগ্রাম মহানগরী ৪১ ওয়ার্ডের একটি স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বপ্ন ধারক নগরী। নগরীর নান্দনিকতা বহুমাত্রিক। প্রাকৃতিকভাবেই এটি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই দৃশ্যমান। প্রাচ্যের রানী বলে কথিত মহানগরী দেশের অন্যতম প্রধান নান্দনিক নগরী। ২২০ বর্গকিলোমিটারের মহানগরী ধারণ করে দেশ ও এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান অর্থকরী নদী কর্ণফুলীকে। নগরীর বৃহৎ অংশ জুড়ে অক্ষয় বঙ্গোপসাগর। যে নামটি পাকিস্তানি শাসকরাও বদলে দিতে পারেনি। সবুজ সুউচ্চ পাহাড় এবং ঘন সবুজ গাছ গাছালির উঁচু-নিচু সমতলের নগরী চট্টগ্রাম মহানগরী।
প্রাকৃতিকতাকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করে ও নগরীটি নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। নগরীর খাল-নালা, জল প্রবাহগুলো বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত। নির্বাচন এলে নির্বাচনী আবর্জনায় খাল নালাগুলো বিপর্যস্ত হয়। আবর্জনার নির্যাসকে অনেক সময়ই ধারণ করতে হয় অর্থকরী নদী কর্ণফুলীকে।
অর্থকরী এবং দেশের প্রবৃদ্ধির শতকরা ৩৫ থেকে ৩৬ ভাগ অবদানকারী নদীটি আমাদের অবহেলা, নির্লিপ্ত এবং নিষ্ক্রিয়তার নির্মম উদাহরণ। আমরা অদ্যাবধি নদীটির প্রতি সুবিচার, উদারতা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারিনি। আমরা নদীটির ভাগ্যকে ছেড়ে দিয়েছি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং আমলাতন্ত্রের হাতে। তারা ইচ্ছামত নদীটিকে ভাবে, নদীটিকে মারে, নদীটিকে পরিচর্যার নামে উত্যক্ত করে, নির্যাতন করে। আমরা নির্লিপ্তভাবে তা অবলোকন করি। হাহুতাশ করি। আহাজারি করি। কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখি না।
দৈনন্দিন এসব কাজের পরও নদীটিকে যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আবর্জনা গ্রহণ করতে হয়, নগরবাসীর পয়োনিষ্কাশনের বিশাল অংশগ্রহণ করতে হয়, নির্বাচনের আবর্জনাকে গিলতে হয়, তখন আমাদের মানবিকতা, চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা বোবা হয়ে যায়।
চট্টগ্রামকে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশাল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার সাথে বিড়ম্বিত কম হচ্ছে না এ নগরের মানুষ। হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ হচ্ছে। প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতার লাগাম এখনও টেনে ধরা যায়নি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতার যথেষ্ট ঘাটতি নিয়ে সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কর্ণফুলী ড্রেজিংএ অনভিজ্ঞ, অজ্ঞ কর্তৃপক্ষের দ্বারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে নালা নর্দমার নব্যতা সুরক্ষার কাজ।
গতিহীনভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে দায়িত্বজ্ঞানহীন দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো। একদিকে পাহাড়ের বিপর্যয়, অন্যদিকে নদীর মুমুর্ষু অবস্থা। মাঝখানে জলাবদ্ধতায় বছরের বিভিন্ন সময়ে হাবুডুবু খাওয়া নগরবাসী। এসব বিড়ম্বনা ও বেসাতি ছাপিয়ে যখন পাঁচ বছর পর সিটি নির্বাচন আসে, তখন মানুষের নির্বাক বিহ্বলতা মূক হয়ে প্রশান্তি খুঁজে।
নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা মানুষকে, নগরবাসীকে প্রশান্তি দিতে ব্যর্থ হয়। আবার ফিরে আসে অসংখ্য মাইকের গগনবিদারী শব্দ, গান, স্লোগান, বৈচিত্র্যময় শব্দের কর্কশ বিড়ম্বনা। ফিরে আসে পোস্টার-ব্যানারের বিড়ম্বিত জীবন।
মানুষ বাস করে ডিজিটাল যুগে। মানুষ প্রত্যাশা করে ডিজিটাল প্রচার-প্রচারণা। শব্দহীন প্রচার-প্রচারণায়। পোস্টারহীন, বিড়ম্বনামুক্ত ডিজিটালাইজড নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। মানুষের প্রত্যাশা অধরা থেকে যায়। মানুষ স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। ফিরে আসে সেই সত্তরের দশক, আশির দশক, কোন কোন ক্ষেত্রে আরও ইতিহাসের ফেলে আসা কালগুলো। চট্টগ্রাম মহানগরীর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র সহ ২৩৭ প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রচার-প্রচারণা পোস্টার-ব্যানার নগরবাসীকে সুখ দেয় না, দেয় বিড়ম্বনা। দেয় স্বপ্নভঙ্গের অনিশ্চয়তা। ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন ভোটারের শ্রবণশক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য জিম্মি হয়ে যায়। প্রার্থীরা জিম্মি করে ৭ মিলিয়ন নগরবাসীকে। বহুমাত্রিক দূষণে আবৃত হয়ে যায় নগরবাসী।
নগরবাসীর পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, জল দূষণ, সবুজ দূষণ, জনগণের স্বাচ্ছন্দ্য দূষণে আমরা এখনও আদর্শ কোন মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারিনি। তার উপর নির্বাচনী বহুমাত্রিক দূষণ আমাদের দিনরাতকে হরণ করে। বর্তমানকে হরণ করে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন, স্বাচ্ছন্দ্যস্বপ্ন দেখানোটা অর্থহীন হয়ে যায়। এটি কাম্য নয়। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। এগিয়ে যাওয়া একটি স্বপ্নময় দেশের আগামী নির্বাচনগুলো ডিজিটালাইজড হওয়া অত্যাবশ্যক।
আগামী কয়েকদিন পরই নির্বাচন। নির্বাচনে সহিংসতা কাম্য নয়। পরিবেশ সহিংসতা অনিবার্য হয়ে যায় এরকম নির্বাচনে। নির্বাচনের সৃষ্ট আবর্জনাগুলো পরিবেশ-প্রতিবেশকে বিপর্যস্ত করবে না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তাদের তৈরি করা, আটিয়ে দেয়া পোস্টার ব্যানারের আবর্জনা নির্বাচন শেষে নিজেরাই সরিয়ে নেবে- নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই এমন ব্যবস্থার অবস্থার তদারকি করবে। নগরবাসী এটি প্রত্যাশা করে সুস্থ পরিবেশের জন্য।
অগ্রসরমান পৃথিবীর এগিয়ে চলার সাথে এদেশের মানুষ এই রকম কার্যকারিতা দেখতে চায়। বিজয়ীদের সাথে পরিবেশের উন্নতি এবং বিজয় দেখার প্রত্যাশায় অপেক্ষমান পরিবেশ প্রেমিক নগরবাসীর।
নির্বাচনের প্রত্যয় হোক মানুষের সুখ, সমৃদ্ধি, সুযোগ-সুবিধা টেকসই নিশ্চয়তা নিয়ে। আজ ও আগামীর সকল প্রকার নির্বাচন হোক টেকসই সমৃদ্ধির। স্বপ্নের যথার্থ বাস্তবতার। পরিবেশ প্রতিবেশ সুরক্ষার।
এভাবেই সংরক্ষিত হোক প্রতিবেশ। সমৃদ্ধ হোক মানুষের টেকসই চেতনা। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রাণময় শুভেচ্ছা ।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, কর্ণফুলী গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘দু’টো বক্তৃতার খসড়াই লিখলাম, জয়ীর এবং পরাজিতের’
পরবর্তী নিবন্ধ‘বুবুজান’