আষাঢ়ে শ্রাবণে নারী কত-কত অনুষঙ্গে

নাযিয়াত মারিয়াম | শনিবার , ১৯ জুলাই, ২০২৫ at ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের বৌদ্ধ গান ও দোঁহা রচয়িতারা লিখেছিলেন ‘এক সো পদমা চৌষট্টি পাখুড়ি / তহিঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী’ অর্থাৎ একশত পদ্মের চৌষট্টিটি পাপড়ির উপরে চড়েই ডোম্বী নাচছিল। আবার নারীর অভাব আর অনটনের চিত্রও ফুটে উঠেছিল অন্য একটি চর্যায় ‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী/ হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী।’ এর পর বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন পদ এবং বড়ু চন্ডীদাসের শ্রী কৃষ্ণ কীর্ত্তনে রাধার চরিত্রে আষাঢ় আর শ্রাবণের বহুমাত্রিক রূপায়ন দেখতে পাই। অগো রাধার কি হল অন্তরে ব্যথা/বসিয়া বিরলে থাকই একলে /না শুনে কাহারো কথা।।/সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে/ না চলে নয়নের তারা, যেন যোগিনীর পারা।।/ আবার বৈষ্ণব কবিদের অন্য পদেও আষাঢ়ে শ্রাবণে নারীদের মনোজগতের চিত্র আমরা পাই। যেমন : রজনী শাওন ঘন ঘন দেখা গরজন/ রিমিঝিমি শবদে বরিষে।/ পালঙ্কে শয়ান বঙ্গে বিগলিত চির অঙ্গে/ নিদ যাই মনের হরিষে।। কিংবা বিদ্যাপতির সেই বিখ্যাত পদ ‘এ স খি, হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শুন্য মন্দির মোর।’ এর পর ষোড়শ শতকের চন্ডীমঙ্গল কাব্যের ফুল্লরার বারমাইস্যাতে বর্ষার দুমাসে ফুল্লরার, সে কি অভাব আর অনটন! ‘আষাঢ়ে পুরিল মহী, নবমেঘে জল বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বর/ মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে /কিছু খুদ কুড়া মিলে উ দর না পুরে/শ্রাবণে ঝরিছে মেঘ দিবস রজনীএরই ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতকে নারীকুল বিরহব্যথা,অর্থকষ্ট আর মনোযাতনা থেকে খানিকটা মুক্তি পায় বটে, কিন্তু আষাঢ় শ্রাবণে আবার তারা হয়ে উঠে কবিতা, গল্প, উপন্যাস তথা গানের মূল বিষয়বস্তুতে। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ঘুরে এসব নারী রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলে এসে যেনো পায় সাহিত্যিক মর্যাদা। লতার গানের মতোই,আষাঢ় শ্রাবণ, মানে না তো মন ঝরো ঝরো ঝরো ঝরো ঝরিছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ উপন্যাসের নায়িকা তিলোত্তমার সাথে শৈলেশ্বর মন্দিরে কুমার জগৎসিংহের যেদিন প্রথম সাক্ষাৎ হয়, সেদিনও ছিল প্রকৃতিতে অঝোর বর্ষণ। তুমুল বৃষ্টি থেকেই নিজেদের রক্ষার্থে তারা নির্জন বনপথে এই ভগ্ন মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সমকালীন কথা সাহিত্যিকদের লেখনীতে নারী চরিত্রগুলো আষাঢ় আর শ্রাবণে পায় বিশেষত্ব। ইশ্বর চন্দ্রগুপ্ত, বিহারীলাল হয়ে রবীন্দ্রনাথ আর কাজী নজরুলের কাব্য, গান আর গল্পে নারীরা আষাঢ়ে শ্রাবণে মিশে বর্ষা ঋতুর সাথে একাত্ম হয়ে যায়। নারীরা এখানে বিরহীনি। আবার নারীর বিরহেও কবি মন ব্যাকুল। কালো মেঘ দেখলে যেমন রাধিকার কৃষ্ণকে মনে পড়তো, এখানেও একই চিত্র। পোস্টমাস্টার এর রতন, জীবিত ও মৃতের কাদম্বিনী ঝড় আর বৃষ্টির ব্যঞ্জনায় সিক্ত হয়েই ট্রাজিক হয়ে ওঠে। আর কবি নজরুল তো শ্রাবণের ভারী বর্ষণ মুখর রাতেই নার্গিসকে ত্যাগ করে বিয়ের আসর থেকেই চলে এসেছিলেন। এই সময় নার্গিসের কেমন লেগেছিল, বিধাতাই জানেন।

আর এজন্য তিনি লিখেছিলেন ‘শাওন রাতে যদি,স্মরণে আসে মোরে/ বাহিরে ঝড়, বহে / নয়নে বারি ঝরে। আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গানেই তো নারী যেনো বরাবরই বর্ষার অনুষঙ্গে দীপ্যমান। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল,আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়েকত কত রচনা। ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় আষাঢ়ে শ্রাবণে কি আকুতিভরা উক্তি ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হয়েও হইলোনা শেষ।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধছায়াসঙ্গী