আশা জাগালেও নেই কোনো সুখবর

চায়না ইকোনমিক জোন

এম নুরুল ইসলাম, আনোয়ারা | শনিবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:১০ পূর্বাহ্ণ

বিদেশী বিনিয়োগের বড় সম্ভাবনায় এগুচ্ছে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরের আনোয়ারা। কর্ণফুলী টানেল চালুর পর এ অঞ্চলে বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় আসে। তারই ধারাবাহিকতায় আনোয়ারায় প্রতিষ্ঠিত কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) যাত্রা শুরুর পর থেকে এই পর্যন্ত জুতা, পোশাক রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা রপ্তানির রেকর্ড, ৩৫ হাজার লোকের কর্ম সংস্থান ও ৩০ লক্ষ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সবুজায়ন প্রকল্পের মধ্যদিয়ে দেশ সেরা পরিবেশবান্ধব শিল্পজোন হিসেবে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু আনোয়ারায় প্রস্তাবিত চায়না ইকোনমিক জোনে বিগত ১০ বছর ধরে চলছে সুনসান নীরবতা। উদ্বোধনের পর থেকে থমকে আছে প্রকল্পটি। টানেল সংযোগ সড়কের মাঝামাঝি একটি বিলবোর্ড বসিয়ে প্রকল্পটিকে নামে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। বাস্তবে ৫৩ হাজার লোকের কর্ম সংস্থানের এই ইকোনমিক জোনের কোনো অগ্রগতি নেই। কবে চালু হবে এই শিল্পজোন তা নিয়েও অনিশ্চয়তা কাটছে না।

সামপ্রতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে কোরিয়ান বিনিয়োগকারী কেইপিজেড’র চেয়ারম্যান ও সিইও কিহাক সাং এর মাধ্যমে কেইপিজেড এ নতুন করে বিদেশী বিনিয়োগ সম্ভাবনা তৈরি হলেও প্রশ্ন উঠেছে কেন, কোন কারণে প্রস্তাবিত চীনা ইকোনমিক জোন অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে ?

সেই কবে ২০১২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে চীনা ইকোনমিক জোন স্থাপনে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর দুই দফায় চীনের দুটি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়ে কর্তৃপক্ষ বদল হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাস্তবতা হলো ইকোনমিক জোনের সামনের সড়ক খালি পেয়ে কিছু লোক গরুর হাট বসিয়েছে। ভেতরের অংশটি গোচারণভূমি। আরেকটু দূরে টানেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বৈকালিক আড্ডার ভ্রমণ স্পট।

২০২৩ সালের আগস্ট মাসে নতুন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশনকে (সিআরবিসি) দায়িত্ব দেয়া হলেও তারা এখন পর্যন্ত তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) দিকে। অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করাসহ প্রক্রিয়াগত কিছু সিদ্ধান্তের জন্য ঝুলে আছে ৫৩ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের প্রকল্পটি। ইকোনমিক জোন প্রকল্পের এডমিন সুপারভাইজার জানান, মূলত আমরা এখনো কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের সাথেই সংযুক্ত আছি। কী হবে, হচ্ছে তার হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই। যতদূর জেনেছি বেজার প্রক্রিয়াগত কাজগুলো হতে আরো সময় লাগতে পারে। এরপরই এই প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে বলা যাবে। বর্তমানে কয়েকজন সিকিউরিটি দিয়ে প্রকল্প এলাকা পাহারা দেয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নাই।

২০১৬ সালে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘি মোড়ের কাছে যখন প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় তখন ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। একই দিনে উদ্বোধন হওয়া বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হয়ে গেছে অনেক আগেই। অবশ্য টানেল চালুর পর প্রস্তাবিত ইকোনমিক জোন এলাকার অর্থনৈতিক মূল্য বেড়েছে। টানেল সড়ক থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরত্বে ব্রিক সলিনের ৪০ ফুট প্রশস্ত সড়কটি চলে গেছে প্রকল্পের গেট পর্যন্ত। চুক্তির প্রথম তিন বছরে প্রকল্প এলাকার ২শ একর পাহাড়ি টিলা সমান করা হয়। বৈরাগ থেকে ইকোনমিক জোন পর্যন্ত চার লেনের এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের বৈরাগ অংশে প্রায় এক কিলোমিটারের সীমানা প্রাচীর রয়েছে। এরপর ৮ বছরে কাজের কাজ আর কোনো অগ্রগতি নেই। যেমন ছিল তেমনই পড়ে আছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ এ অরক্ষিত প্রকল্পের ভেতর দুষ্কৃতকারীরা বানিয়েছে নানান অপরাধ ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের আস্তানা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের মূল ফটক আর ভেতরের অস্থায়ী ভবনে সাইনবোর্ডই ঝুলছে শুধু। আর কোনো কার্যক্রম নেই। সামনের রাস্তায় গরু বিচরণ করছে। ৮জন নিরাপত্তাকর্মী পাহারা দিচ্ছেন এলাকাটি।

গত বছরের ১৬ আগস্ট ‘চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন (সিইআইজেড)’ গড়ে তোলার কাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয় চীন সরকারের মনোনীত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিআরবিসিকে। অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির (ডিপিএম) মাধ্যমে সিআরবিসির সঙ্গে চুক্তির জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) একটি প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। চীনা প্রতিষ্ঠানটি ৭৮৪ একর জমিতে জিটুজি (দু’দেশের সরকারি পর্যায়) ভিত্তিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার কথা। জোনটি সম্পূর্ণরূপে চীনের উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দকৃত। এই অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চলে কেমিক্যাল, অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলিং, গার্মেন্টস ও ওষুধ কারখানা হওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।

এরপর বেজার চেয়ারম্যান আনোয়ারায় প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে

আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যান দ্রুত জমা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। কিন্তু এরপরও প্রকল্পের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত ঠিকাদার জটিলতার কারণেই থেমে আছে এই প্রকল্পের কাজ। কী কারণে এই বিলম্ব, জটিলতা ঠিক কোথায় তাও কোনো পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হচ্ছে না।

২০১৪ সালের জুনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চীন সফরকালে চীনা সরকার বাংলাদেশের চট্টগ্রামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চল স্থাপনের আগ্রহ ব্যক্ত করে। ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর দুই বছর পর চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ঢাকা সফরে এলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।

এ সময় ঠিক হয় অর্থনৈতিক অঞ্চলটির অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও বেজার সঙ্গে চায়না হারবারের কোনো চূড়ান্ত চুক্তি না হওয়ায় দীর্ঘ ছয় বছর দায়িত্ব দেওয়া হয় চীনা সরকারের মনোনীত সিআরবিসিকে। এরপর একবছর ৮ মাসের বেশি সময় পার হতে চললেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি বড় কর্মসংস্থানের এই ইকোনমিক জোন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্ত্রাসী কাটা রফিক কারাগারে
পরবর্তী নিবন্ধ১৮ এপ্রিলকে জাতীয় যুব দিবস ঘোষণা করার দাবি